চবির ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস গবেষণা করতে সুন্দরবনে



সুবিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ও অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সুন্দরবন। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের এই বনের মধ্য দিয়ে জালের মত ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় খাল, আঁকাবাঁকা নদী আর বিচিত্র বৈশিষ্টের গাছপালা, আছে রংবেরং এর পাখপাখালি, অসংখ্য বন্য প্রাণী এবং বিভিন্ন ধরনের মিঠা পানি ও সামুদ্রিক মাছ। সম্প্রতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এর ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সুন্দরবনে একটি গবেষণা জরিপ সম্পন্ন করেছে আমাদের ইনস্টিটিউট এর বেশ কয়েকজন গবেষক। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাত্রা শুরু করে সকাল ৭ টায় আমরা মংলাবন্দরে পৌঁছাই। “পেলিকান” নামের একটি রিসার্চ ভ্যাসেলে নির্দিষ্ট সময়ের যাত্রা বিরতির পর ১ম দিন আমরা মংলা বন্দর থেকে পর্যায়ক্রমে হারবাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র এবং আন্দারমানিক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র ভ্রমণ করি। সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী দেখার পাশাপাশি আমরা উপভোগভোগ করি ঐদুটো অঞ্চলের প্রাকৃতিক সুন্দর্য। পরে আমরা ঐ অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভ করি। রিসার্চ ভ্যাসেলে রাত্রি যাপন করার সময় সমুদ্র উপকূলে রাতের সুন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি আমরা ঐ অঞ্চলগুলোর জীব বৈচিত্র্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি।


২য় দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা টাইগার পয়েন্ট হয়ে জামতলা সী-বিচ দেখতে যাই। সী-বিচে যাওয়ার পথে হরিণ
, বাঘের পাগমার্ক দেখার পাশাপাশি লোনা পানির সুন্দরবনে লবন অসহিঞ্চু জাম গাছ দেখতে পাওয়ার বিষয়টি আমাদের বিষ্মিত করেছে। জামতলা সী-বিচ এ আমরা নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করার বিষয়টি ভালো ভাবে লক্ষ করি। আমরা দেখতে পাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জামতলা সমুদ্র সৈকতের উপরিভাগের বালি সুন্দরবনের বিভিন্ন উদ্ভিদের শ্বাসমূলগুলোকে ঢেকে দিয়েছে, ফলে অক্সিজেন সল্পতায় মারা যাচ্ছে ঐ অঞ্চলের অসংখ্য লোনাপানির উদ্ভিদ। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অতিরিক্ত লবানাক্ততা, অধিকাংশ পর্যটকদের বন সম্পর্কিত জ্ঞান স্বল্পতারর কারণে সুন্দদরবনের প্রতিনিয়ত সংকটময় পরিস্থিতিতে উপনিত হওয়ার বিষয়টি আমাদেরকে ভীষণভাবে ভাবিয়েছে। তারপর ট্রলারে করে কটকায় গিয়ে সেখানকার গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও ঐ অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমরা বাস্তব জ্ঞান লাভ করি। ২য় দিন দুপুরে ডিমের চর সমুদ্র সৈকতে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে সন্ধায় আমরা কচিখালির প্রাকৃতিক সুন্দর্য দেখতে যাই। ৩য় দিন সকালে আমরা করমজলে কুমির, কচ্ছপ, হরিণের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র দেখতে যাই এবং সেখানকার জীব বৈচিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারনা নেই। রাতে আমরা দিনের বেলায় দেখে আসা অঞ্চলগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করি এবং তাদের মধ্যকার পারষ্পারিক সম্পর্ক, বৈপরীত্যের কারণ জানার চেষ্টা করি।

এই সম্পূর্ণ যাত্রা পথে আমরা ঘুরে আসা সবগুলো অঞ্চলের বিভিন্ন গাছপালা, প্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে তাদের পারস্পারিক মিথঃস্ক্রীয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা জেনেছি সুন্দরবনের অতিরিক্ত লবানাক্ততায় বিভিন্ন গাছের উচ্চতা প্রতিনিয়ত ছোট হয়ে আসছে। আর এই অতিরিক্ত লবানাক্ততা থেকে মুক্তির জন্য সুন্দরী গাছের অতিরিক্ত পরিমাণে শ্বাসমূল গঠন এবং আগা মরা রোগের বিষয়টিও আমরা লক্ষ করেছি। এছাড়াও সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকায় আছে অসংখ্য সরীসৃপ প্রাণী। বন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানা গেছে, ইদানিং কালে কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের বদৌলতে সুন্দরবনে দিনকে দিন হরিণ ও কুমিরের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে বাঘের সংখ্যাও। ৩য় দিন রাতের খবার শেষ করে আমরা খুলনা পৌঁছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বাস যাত্রা শুরু করি। 

এই গবেষণা জরিপ নিয়ে অত্র ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক, ড. মোহাম্মদ সাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, "বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় দূষণের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব ও দূষণের মাত্রা নিরূপণে চবির মেরিন সায়েন্স এর এই জরিপে ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ নদীপথে ৩৪ টি লোকেশন হতে জৈব, ভৌত ও রাসায়নিক গুনাগুন পরীক্ষায় মাটি ও পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ম্যানগ্রোভ বনের উদ্ভিদরাজীর বর্তমান অবস্থা নিরূপণের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান, উৎপাদন ক্ষমতা, উদ্ভিদ ও প্রাণী কণার মজুদ এবং তাদের পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া পর্যালোচনার জন্য সাতটি ইকোলজিক্যাল কম্পার্টমেন্টে গভীর পর্যবেক্ষণ চালানো হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঢেউ এর প্রভাবে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙ্গন ও ভাঙ্গনের কারণে সৃষ্ট পলির পরিমাণ ও পানির প্রবাহ সম্পর্কে পরবর্তিতে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে আমাদের এই জরিপে।" 

উল্লেখ্য যে, সুনীল অর্থনীতির এই আধুনিক যুগে সমুদ্র সম্পর্কিত জ্ঞানকে পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে দিতে, বিশাল সমুদ্রের মৎস সম্পদ আহরণ, অন্যানন্য সমুদ্র সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার, সমুদ্রের উপরিভাগ এবং তলদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সাল থেকে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস সমুদ্র বিজ্ঞানের উপর পাঠদান করে আসছে।

 

মো. রাফছান

শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্সেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল : rafsan.cu.ac@gmail.com

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন