কাঁধের ব্যাগে গুজে দেওয়া বইয়ের জ্ঞানে কতটুকু এগোয় মানুষ, কতটুকু এগোয় সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী। যে শিক্ষায় কৃষক, শ্রমিকের টাকায় নির্মিত শিক্ষালয়ে তৈরী হয় কোট টাই পড়া ভদ্র চোর। যেখানে শিক্ষার্জিত সার্টিফিকেটের বিসর্জনে মানুষের টাকায় তৈরী হয় জগৎখ্যাত অমানুষ। যে শিক্ষায় দূরত্ব ঘোচে না মনুষ্যত্বে, দূরীভূত হয় না দেহের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা গভীর অন্ধকার। যে শিক্ষা নিয়েই দক্ষ হয় একদল প্রতারক, লাঞ্ছনাকারী, ধর্ষক সমাজ, মাথা উচু করে বাঁচে পরের টাকায় বড় হওয়া সাহেবি গোষ্ঠী। দিনশেষে শিক্ষা, শিক্ষিত বলে আসলেই কি কিছু রইল, সুশিক্ষার আদলে প্রত্যাশিত মানবিকতা কি আসলেই জুটে কপালে? নাকি রুটিন করে এভাবেই বাঁচতে হবে এই শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে, কায়দা করে, লুকিয়ে থেকে, চাঁপিয়ে রেখে।
কি এক অদ্ভুত হৃদয় বিদারক দৃশ্য! শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই চলছে ট্যাংকার-বুলেট, জলকামান আর লাঠি পেটায় হরহামেশাই ঝরছে অসহায় শিক্ষার্থীর লাল রক্ত। এই শিক্ষার্থীরা কারা? এরাই কি সেই মানুষ না, যাদের জন্যই আপনারা আজ শিক্ষক, যাদের জন্যই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? শিক্ষার্থীদের হাজারও ভুলের বিপরীতে শিক্ষা দেওয়ার মহান উদ্দেশ্যেই তো শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন। তাহলে দুর্বল শিক্ষার্থীদের উপর কেন ক্ষমতার এই ঔদ্ধত্য? সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ছাত্রদের শশীর থেকে রক্ত ঝড়ছে। কখনও গভীর রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় সশস্ত্র হামলা, তুচ্ছ ঘটনায় কখনও বা আবার হামলার শিকার হয় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগরে প্রায়শই মার খাচ্ছে শিক্ষার্থী, ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও হরহামেশাই ঘটে একই ঘটনা। টিন কাঠের যুগ পাল্টে ইট কংক্রিটের যুগ আসলেও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চার এই শিক্ষালয়ে বদলায়নি অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের রক্তদানের ইতিহাস।
ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে ছাত্রদের উপর বারংবার অতর্কিত হামলাই কি তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চা? যে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চার জন্যই ছাত্ররা দিন ও রাতের ঘুম এক করেছিল। যে জ্ঞান-গবেষণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গাঢ় লালে, যায়গা বেযায়গায় হওয়া আঘাতের চিহ্নে। আজ কোথায় আমাদের শিক্ষকদের মানবিকতা, কোথায় গেলো তাঁদের শিক্ষার মহান ব্রত? কোথায় গেলো ভুল, অনিয়মের বিপরীতে দেওয়া প্রয়োজনীয় শিক্ষা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকদের শিক্ষার্থীবান্ধব না হতে পারার এই দ্বায় কাদের? শিক্ষার্থীদের পাওয়া না পাওয়ার অভিযোগ শুনবেন বলেই তো আজ আপনারা শিক্ষক, আপনারা প্রভোস্ট, আপনারা প্রক্টর। তাহলে, তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে কেনইবা আন্দোলন করতে হবে, সামান্য দাবি আদায়ে আমাদের ভাইদের কেনই বা ঝরাতে হবে বুকের তাজা রক্ত।
শিক্ষার্থীদের অনিয়ম সমাধান রুখতে আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও হরহামেশাই ঘটছে পালটা অনিয়ম। প্রায়শই আহত হচ্ছে শিক্ষার্থী, নিয়ম-অনিয়মের বলি হয়ে অসময়েই জীবন হারাচ্ছে হাজারও প্রতিভাবান তরুণ। অনেক শিক্ষকই আজকাল শিক্ষার্থীদের ছাত্র মনে করেন না, ছাত্ররা তাঁদের কাছে বিবেচিত হয় প্রতিপক্ষ হিসেবে। দিনশেষে যতদিন পর্যন্ত ছাত্র শিক্ষক এক হওয়া সম্ভব হবে না, শিক্ষার্থীদের পাওয়া না পাওয়ায় শিক্ষকদের মন কাঁদবে না, যতদিন ছাত্রদের পিঠ চাঁপড়ে ভালোবাসা বিলাতে পারবে না আমাদের তথাকথিত শিক্ষক সমাজ, ততদিন এই দেশ বদলাবে না, এই পৃথিবী বদলাবে না। ততদিন পর্যন্ত এই দেশ শিক্ষার হবে না, শিক্ষার্থীর হবে না, হবে না শিক্ষকেরও।
যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর পিঠ চাপড়ে ভালোবাসা বিলায় তাঁদেরকে আমার হাজার সালাম। হাজার সালাম সেসকল শিক্ষকদের জন্যও যারা শিক্ষার্থীদের সাথে হাসিমুখে কথা বলেন, তাদের অভিযোগ শুনেন, সমস্যায় দৌড়ে আসেন, সমাধানের চেষ্টা করেন কিংবা নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের দ্বায়িত্বটুকু সুচারু ভাবে পালন করেন। শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহকে মূল্যায়ন, যেকোনো ভুলে তিরস্কারের বিপরীতে বুঝিয়ে দেওয়া, ন্যায্য দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন কিংবা সহযোগিতা, শিক্ষার্থীদের সাথে আন্তরিক হওয়ার মাধ্যমে আরও সুদৃঢ় হোক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বন্ধন। বিভিন্ন ব্যস্ততা দুরে ঠেলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সময়মতই চলুক পাঠদান প্রক্রিয়া। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে তৈরী হোক শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ, তাঁদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা আর বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষায় জ্যামিতিক হারে বাড়ুক ছাত্র-ছাত্রীদের শেখার আগ্রহ। শিক্ষার্থীর এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটা ইতিহাসে শিক্ষকরা স্থান পাক প্রিয় শিক্ষক হিসেবে। স্থান কাল পাত্র নির্বিবাদে নিশ্চিত হোক শিক্ষার্থীদের সুষম মূল্যায়ন। শিক্ষার আলো আরেকবার জ্বলে ওঠুক আমাদের মানবিক হৃদয়ে, সৎ কর্মনিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হোক প্রত্যাশিত আদর্শ নাগরিক সমাজ।
শিক্ষার্থীরা প্রতিপক্ষ নয়। হামলা বিপরীতে ভালোবাসা দিলেই এই শিক্ষার্থীরা বদলে যাবে। দেশ গড়ার যে মহান বাসনা প্রতিটা শিক্ষকদের শিরদাঁড়ায় বইছে, সে মহান বাসনা প্রতিটা সচেতন শিক্ষার্থিদের মনকেও কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। একই উদ্দেশ্য থাকার পরেও শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝে কেন এই হাজার মাইলের দূরত্ব? পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার পরেও একজন শিক্ষক কেনই বা পারছেন না শিক্ষার্থীবান্ধব হতে। আগামি দিনে এই শিক্ষার্থীরাই যদি আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠতে না পারে তাহলে কোথায় কাজে লাগবে এই আমাদের শিক্ষার্থীদের ২০-২২ বছরের পুথিগত শিক্ষা, কোথায় প্রয়োজনে লাগবে শিক্ষকদের শিক্ষাদানের নিমিত্তে ব্যয়িত পরিশ্রম। বর্তমান সময়ের এইসব ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে কি শিখছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? এনারাই তো একদিন শিক্ষক হবেন, সময় অসময়ে বনে যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারক। কিন্তু, তখন? ঠিক এভাবেই কারো না কারো সন্তানদের উপর চলবে এই রকম অমানবিক নির্যাতন, ইচ্ছার খামখেয়ালিপনায় ঝড়বে সহস্র নিরপরাধ শিক্ষার্থীর লাল রক্ত। দিনশেষে, শিক্ষকদের ভালোবাসা, আন্তরিকা আর সহযোগিতা পেলেই এই ছাত্র সমাজ বদলে যাবে। বন্ধ হবে ঝড়ে পড়া, কমে যাবে বিশৃঙ্খলা আর অনিয়ম, ক্রমশই বাড়বে পড়াশোনার অগ্রগতি। শিক্ষার যে মহান ব্রত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাঁধে চেঁপেছে তা আন্তরে লালন করে কাজে কর্মে একজন শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সকল পর্যায়ে শিক্ষকদের সব সময়ই শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়াটা খুবই জুরুরি। সবকিছুর পরেও দিনশেষে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার হোক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীর হোক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হোক শিক্ষকেরও।
মোঃ রাফছান
শিক্ষার্থী মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন