আতঙ্ক, মহামারি, অবরুদ্ধ চারপাশে আটকে গেছে ধ্বংশালী মানবতা। সাড়ে তিন হাত দূরের এই বিশেষণ তল কি ভীষণভাবেই না আগলে ধরছে মৃত লাশ। অজানা আতঙ্কে আকস্মাৎ থমকে গেছে জনতা, ঘরবন্ধি হয়েছে কোটি কোটি শ্রমবাহিনী শরীর। কি এক নিদারুণ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা, ভবিষ্যৎ নয় চারদিকে শুধু বেঁচে থাকার হাপিত্যেস! আইসিও নেই, ভালো চিকিৎসক নেই, ভালো হাসপাতাল নেই, উন্নত চিকিৎসার জন্য নেই প্রয়োজনীয় অর্থ। এরকম হাজার নাই এর মধ্য দিয়ে দ্রুতবেগে এগিয়ে চলছে মৃত্যুর মিছিল, ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের সারি। সবকিছুর বিনিময়েও জীবননাশী করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত অক্সিজেন আর সঠিক চিকিৎসার অভাবে অতি সহজেই মৃত্যুকে আপন করে নিচ্ছে অসহায় মানুষ। উন্নত আইসিও, প্রশিক্ষিত ডাক্তারদের চোখের সামনেই মানুষ মারা যাচ্ছে একের পর এক। সবকিছু উপেক্ষা করে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পেটের দ্বায়ে জীবন হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ছুটছে একদল খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানোমিটারের এক ভাইরাসেই পরাক্রমশালী মহাকাশজয়ী পৃথিবীর মৃত্যুর কাছে কি এক অসহায় আত্নসমর্পণ। কি অবলীলায় একের পর এক বর্থ হচ্ছে করোনা ভাইরাস মোকাবেলার হাজারও প্রচেষ্টা। মৃত্যুর সংখ্যায় হ্রাস টানতে যথেষ্ট হচ্ছেনা ভ্যাক্সিনেশন কিংবা কঠোর লকডাউনও।
করোনার ভয়াবহতায় গত বছরের ২৬শে মার্চ থেকেই দেশে আনুষ্ঠানিক লকডাউনের শুরু, সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ১৭ই মার্চ ২০২০ থেকে। সংকট মোকাবেলায় মে মাসের শেষের দিকেই তুলে দেওয়া হয়েছিল লকডাউন, স্বল্প পরিসরে খোলে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টসসহ সব ধরনের সরকারি দফতর। করোনার প্রকোপে বারংবার লকডাউন দেওয়া এবং তুলে নেওয়ার মাঝেই পেরিয়ে গেছে পুরো ১ টি বছর। অস্থিতিশিল অবস্থা মোকাবেলায় করোনার বিস্তার কমাতে ১৪ই এপ্রিল থেকে পুনরায় ঘোষণা করা হয়েছে সাত দিনের 'কঠোর লকডাউন'। এই সময়ে জরুরি সেবা ব্যাতীত সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিতসহ সব ধরণের অফিসের পাশাপাশি কল কারখানা ও যান চলাচল বন্ধ থাকবে। করোনা পরিস্থিতির অবনতির দরুণ ফের বেড়েছে লকডাউনের দৈর্ঘ। উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে এলেও এই মহামারি এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে ভারতের দিল্লীতে করোনা মহামারীর প্রকোপে প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে ২ হাজারেও বেশি মানুষ। সাস্থ অধিদপ্তের তথ্যানুযায়ী, ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫৮ লক্ষ মানুষ করোনার প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ২১ লাখ মানুষ।
দীর্ঘসময় ধরে চলমান এই কঠোর লকডাউনে বিপাকে দেশের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ। অর্থিক দৈন্যদশা আর প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দেশের বিভিন্ন অংশের এই চাকুরিচ্যুত, খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগন। চাকুরি নেই, কাজ নেই, বাহিরে যাওয়ারও সুযোগ নেই, অনেকাংশেই মিলছেনা সরকারী ত্রাণ কিংবা অর্থ সুবিধা টুকুও। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনাভাইরাস সৃষ্ট লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ নিম্ন-আয় ও মধ্য-আয়ের দেশের প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ তীব্র খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হয়েছে। মে মাসে প্রকাশিত ব্র্যাকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারী কারণে দেশের প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, কাজের সুযোগ হারিয়েছেন পুরো দেশের ৬২ শতাংশ দিনমজুর। জীবন-জীবিকা পরিচালনার এই কঠিন প্রশ্নে পিছলে গিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভীত। করোনা সংকটের পূর্বে ৭.৫-৮% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগুচ্ছিল ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে। ফলাফল স্বরূপ দারিদ্র্যের হার কমে আসার পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন সূচকেও এসেছিল ইতিবাচক পরিবর্তন। খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুসারে, ২০১০ সালে যেখানে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ১৭.৬ শতাংশ, ২০১৬ সালের তা নেমে এসেছিলো ১২.৯ শতাংশে (প্রায় ২ কোটি ২১ লক্ষ মানুষ)। কিন্তু সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি জরিপে বলা হয়েছে, মহামারির এই অস্থিতিশীলতায় অতি দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ, লকডাউনের পর দেশে অতি দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমেছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ।
প্রকৃতির এই করুণ খেয়ালে ধসে পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত গার্মেন্টস শিল্পে ধ্বস নেমেছে। করোনাকালীন এই দুঃসময়ে একমাত্র বৈদেশিক রেমিটেন্সের পরিমাণই উর্ধ্বমুখী। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ (১৮.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসী শ্রমিকরা। যা ছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। তবে দেশীয় পরিবহন, উৎপাদন এবং রপ্তানীমুখর শিল্পেও ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে রাজস্ব আয়ের হিসেব। তথাপিও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করার শর্তে গার্মেন্টস, শিল্প খুলা রেখে ভঙ্গুর অর্থনীতির বেহাল অবস্থা দূরীকরণে পুরোদমে কাজ করছে সরকার। করোনাভাইরাসেরর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে ইতিমধ্যেই ৭২ হাজার কোটি টাকারও বেশি আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে বর্তমান সরকার। যার মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য বরাদ্ধ করা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার কোটি, রপ্তানিমুখর শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে বরাদ্ধ হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ ৫ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
মৃত্যুবাণে দুর্বার প্রতাপে এগিয়ে চলা করোনাকে থামানো যাচ্ছেনা কোনো ক্রমেই। অবিরাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়িয়ে চলেছে তার শিকারের সংখ্যা। অনিঃশেষ ধেয়ে চলা এই করোনার আজ পৃথিবীময় রাজত্ব। অপন রক্ত ছেড়ে যাচ্ছে আপন হৃদয়, পাশে থেকেও বাড়ছে কাছে থাকার দূরত্ব। এক অজানা অশংকায় ভীতসন্ত্রস্ত পুরো মানব সমাজ। এক করোনায় এসে মিলিত হয়েছে বড়-ছোট, উচু- নিচুর বাধা ব্যবধান। আরও একবার স্রষ্টায় বিশ্বাসের প্রয়োজনবোধ জন্মেছে বর্বর, স্বার্থপরায়ণ মানব হৃদয়ে। অহিংসা, ভাতৃত্ব ফের এসেছে মহামারীর আতঙ্কের ডেরায়। বর্ণবিদ্বেষ ভুলে সকল ধর্মের মানুষ করোনা মোকাবেলায় একজোট হয়েছে, যার ইতিবাচক ফলাফলে ক্ষণেক্ষণে মানুষে মানুষে তৈরী হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতার কিছু অনন্য উদাহরণ।
করোনায় আতঙ্কিত নয়, সতর্ক হওয়া প্রয়োজন আমাদের করণীয় কর্মকান্ডে, কর্তব্যে, প্রয়োজনে। জেনে নেওয়া দরকার সঠিক করণীয় কিংবা কোনটা করা উচিৎ। সর্বত্র মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করার পাশাপাশি মানতে হবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ সতর্কতা। সময় অসময়ের কিছু পছন্দ, সখ, আর ভালো লাগার বলিদান দিতে হবে মানবতার প্রয়োজনে। আত্নসাৎ, স্বার্থসিদ্ধি, চাটুকার, অপচয়, হিংসার নষ্টামি বন্ধ করে করোনা মোকাবেলায় আমাদের কাজ করতে হবে হাতে হাতে। তাবুত অপকর্ম প্রতিস্থাপিত করতে হবে জীবন রক্ষাকারী মহিমান্বিত গুণে। অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে স্রষ্টার দেওয়া ধর্মীয় বিধিনিশেধ। ধনী-গরিব আর বর্ণবৈষম্য ভুলে হাটতে হবে সমবায়, সমান, সমতার পথে। করোনার এই ক্রান্তিপর্বে ডানা মেলুক বেঁচে থাকার নতুন কোন দুর্বোধ্য সমীকরণ। বিবেকের আইসিউতে আরও একবার পরিশুদ্ধ হোক কৃষ্ঞকায় নষ্ট হৃদয়। লকডাউনের এই দুর্বিষহ করুণ সময় নতুন করে জানতে শিখাক প্রয়োজনবোধ, শিখিয়ে দিক অস্থিতিশীল জুরুরী দূরাবস্থায় টিকে থাকার কোন অভাবনীয় কলাকৌশল। দুঃসময় পেরিয়ে বেঁচে থাকুক নির্বিবাদী, সত্যনিষ্ঠ অসহায় প্রতিবেশী সমাজ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন