বাংলাদেশে কোটাব্যবস্থা মূলত প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য চালু করা হয়েছিল। পরবর্তিতে অসংখ্যবার তার পরিবর্তন, পরিমার্জনের ফলে বর্তমানে এটি একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোটার পরিমাণ বৃদ্ধির ঘটনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই অসম কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্থানীয় জেলা এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে আন্দোলন করছে ছাত্র সমাজ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তীব্র আন্দোলনের মুখে পুলিশ, বিজিবির গুলি, টিয়ারগ্যাস ও গ্রেনেড হামলার ফলে ইতোমধ্যেই ৬ জন ছাত্র নিহত হওয়ার পাশাপাশি গুরুতর আহত হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরকারি চাকরি এবং শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সাল থেকেই চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও নারী কোটা ছিল। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কর্পোরেশন ও দপ্তরে নিয়োগ এবং কোটা বণ্টনের বিষয়ে ১৯৭২ সালের পাঁচই সেপ্টেম্বর একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে তৎকালীন সরকার। প্রাথমিকভাবে, এতে নারীদের, জাতিগত সংখ্যালঘুদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সময়ের সাথে সাথে, সিস্টেমটি সম্প্রসারিত হয়, যার ফলে বিভিন্ন সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অংশই এখন এই কোটার আওতাভুক্ত। এই কোটা ব্যবস্থা মানুষকে সহযোগিতা করার প্রশংসনীয় উদ্দেশ্য অনুমোদন দিলেও, বর্তমানে পুনরায় অযৌক্তিকভাবে কোটার পরিমাণ বৃদ্ধি করায় দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এই সিস্টেমটি তুমুল ভাবে সমালোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক এবং শিক্ষা খাতে প্রায় ৫৬% সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন বিভিন্ন কোটার অধীনে সংরক্ষিত। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত আছে ৩০%, নারীদের জন্য ১০%, পশ্চাদপদ এলাকার জন্য ১০%, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ৫%, এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত আছে ১% কোটা । কোটাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার, শিক্ষা ও চাকুরির ব্যাপারে ন্যায্যতা ও মেধাবি শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরী হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক বিভাজন।
কোটাব্যবস্থার অন্যতম উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব হল মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধার অবমূল্যায়ন। আমাদের দেশে মেধাবীরা প্রায়শই যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য অবস্থানে পৌঁছাতে পারে না। কোটার ব্যাপক সংরক্ষণের কারণে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রাপ্য চাকুরি থেকে বঞ্চিত হয় হাজারো শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি গবেষণায় দেখা যায়, কেবলমাত্র ৪৪% সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। যা ছাত্রদের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করে, এটি তাদের পরিশ্রম এবং কৃতিত্বের জন্য এক বিরাট অববমাননা। এছাড়াও, কোটাব্যবস্থার ফলে তুলনামূলকভাবে বিভিন্ন সরকারি চাকুরি পরিক্ষায় অদক্ষরা বেশি নির্বাচিত হয় যা অদূর ভবিষ্যতে দেশের সেবা ও উন্নয়নের গুণগত মান হ্রাস করবে।
কোটাব্যবস্থা, সমতার প্রচারের বিপরীতে, অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি বৈষম্যকে উৎসাহিত করে। কোটার বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এই বঞ্চনার অনুভূতিকে করে আরও তীব্র। যার ফলে ইদানিংকালে ক্রমশই শিক্ষার্থীদের আস্থা কমছে এই ভঙ্গুর, বৈষম্যমূলক সিস্টেমের প্রতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭২% শিক্ষার্থী কোটাব্যবস্থাকে অন্যায় মনে করে এবং তারা অনতিবিলম্বে এর যৌক্তিক সংস্কার চায়। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ সামাজিক সংহতিতে বাধা সৃষ্টি করছে এবং কমাচ্ছে আত্মনির্ভরতা।
কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, ব্যাপক প্রতিবাদের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী তীব্রতর অবস্থায় চলমান রয়েছে। আন্দোলনের গতি কমাতে রাস্তায় নেমেছে পুলিশ, বিজিবি এবং ছাত্রলীগ। হলগুলো বন্ধ করে জোরপূর্বক শিক্ষার্থীদের বাড়ি পাঠানোর পাশাপাশি পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহীনিকে দেওয়া হয়েছে ছাত্রদের উপর গ্রেনেড, টিয়ারগ্যাসসহ গুলি করার সর্বোচ্চ ক্ষমতা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জামাত, শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধরের পাশাপাশি, যেখানে সেখানে তাদেরকে ছুরিকাঘাত করা হচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের পেটানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যমে পুরো আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ।
সামপ্রতিক সময়ে তরুণ সমাজ মনে করে, তৎকালীন সময়ে কোটাব্যবস্থার প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কোটার বরাদ্ধকৃত অংশ কমিয়ে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আশার পাশাপাশি তারা চায় তাদের মেধাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মত একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিস্টেম। এই যৌক্তিক সংস্কারের দাবি কোটাব্যবস্থাকে পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এর মাধ্যমেই আগামি দিনে চাকুরি পরিক্ষাসহ সব ধরনের প্রতিযোগীতামূলক পরিক্ষায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্যতা এবং সতস্ফুর্ত অংশ্রগহন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন গবেষণা এবং পরিসংখ্যান ছাত্রদের এই অভিযোগগুলিকে সমর্থন করে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণায় দেখা যায়, কোটার সুবিধাভোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তুলনামূলকভাবে সচ্ছল পরিবারের, যা সিস্টেমের মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষুন্ন করে। এছাড়াও, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তথ্যানুসারে, অনেক মেধাবী ছাত্র উচ্চ শিক্ষা বা সরকারি চাকরি পেতে ব্যর্থ, কোটার কারণে এখানে উন্মুক্ত পদের প্রাপ্যতা খুবই সীমিত। এই অসঙ্গতি এবং বৈষম্য প্রমাণ করে যে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এবং একটি মেধা নির্ভর সিস্টেমের জন্য ছাত্রদের এই দাবি পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নতুন নয়। ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলি দেখায় যে সময়ে সময়ে কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, যা কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘকালীন অসন্তোষের প্রমাণ দেয়। সাম্প্রতিক আন্দোলন, বিশেষত ২০১৮ এর আন্দোলন, বাংলাদেশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমতার জন্য বৃহত্তর সংগ্রামের অংশ। এই আন্দোলন পরবর্তি সময়ে কোটা ব্যবস্থার টেকসই এবং যৌক্তিক সংস্কার এখনও অধরা।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং তীব্রতা সরকারকে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। ২০১৮ সালে, প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকরির জন্য কোটাব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেন, যদিও এর বাস্তবায়ন অসম হয়েছে। এটি ছিল তৎকালীন আন্দোলনকারীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন, তবে চলমান আলোচনা এবং বিতর্কগুলি ইঙ্গিত দেয় যে বিষয়টি এখনও পুরোপুরিভাবে সমাধান হয়নি।
বাংলাদেশের কোটাব্যবস্থার সংস্কারে একটি বহু-মুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। প্রথমত, সংরক্ষিত পদের সামগ্রিক শতাংশ কমানো, সেইসাথে প্রকৃতপক্ষে যোগ্য প্রার্থীদের চিহ্নিত করতে একটি মেধা-নির্ভর সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও, বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং পরিবর্তনশীল সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রতিফলিত করতে নিয়মিতভাবে সিস্টেম পর্যালোচনা করা একটি পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটা সংশোধণ করা।
বাংলাদেশে কোটাব্যবস্থা, অন্তর্ভুক্তির একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলেও, ইদানিংকালে তা একটি বিতর্কিত এবং অসমতার উৎসে পরিণত হয়েছে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মেধা-নির্ভর সুযোগ-সুবিধার জন্য শিক্ষার্থীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এই আন্দোলন সম্পূর্ণ যৌক্তিক। ছাত্র সমাজের এই নৈতিক আন্দোলনে দেশীয় বুদ্ধিজীবীদের শ্বশরীরে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সার্বিক সমর্থন এই মুহুর্তে শিক্ষার্থীদের ভীষণভাবে সহযোগিতা করবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমগুলোতে প্রচার ও প্রসার কিংবা সরাসরি বৈদেশিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই চতুর্মুখী সংঘর্ষ কমিয়ে আনা সম্ভব। কোটাব্যবস্থার ইতিহাস, ব্যাপ্তি এবং নেতিবাচক প্রভাবের প্রেক্ষিতে, আজকের এই সময় কোটা ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। মেধা ও কোটার ভারসাম্য বজায় রেখে, বাংলাদেশ আরও সময়োপযোগী এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে এচিরেই এই অস্থিতিশীল দূরাবস্থার সমাধান হবে।

0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন