প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সংকট, আধুনিক
সভ্যতার এই প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীর শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে প্লাস্টিক
দূষণের বিষাক্ত প্রবাহ। এই সিন্থেটিক পলিমারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আর অবাধ
প্রাকৃতিক দূষণের বহুমুখী প্রতিক্রিয়ায় সংকটময় পরিস্থিতিতে আমাদের বাংলাদেশ।
বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলীর স্বচ্ছ জলে আজ ভেসে
বেড়াচ্ছে প্লাস্টিক বোতল, পলিথিনের ব্যাগ আর প্রাণঘাতী
সিন্থেটিক বর্জ্য। পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নাইলন, পলিথিন, পিভিসি, থার্মোপ্লাস্টিক,
প্লাস্টিক শীট আর প্লাস্টিক ফিল্মের মত অসংখ্য প্লাস্টিক
মেটেরিয়েল। প্লাস্টিকের এই মরণ-ফাঁদে ধ্বংসের পথে দেশের মৎস্য সম্পদ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি, মানুষের জীবন ও
জীবিকা। পরিবেশ দূষণের এই ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় সার্কুলার ইকোনমি হতে পারে
একটি টেকসই সমাধান, একটি সময়োপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ।
শিল্প ও প্রকৃতির সমন্বয়ে প্লাস্টিক পণ্যের সীমিত ও পুনর্ব্যবহার এবং রিসাইক্লিং
এর মাধ্যমে যেখানে বর্জ্যই হয়ে উঠবে অর্থকরী সম্পদ। দেশে প্রচলিত হবে নতুন এক
অর্থব্যবস্থা, বাড়বে কর্মসংস্থান, মিলবে হাজারো মানুষের জীবিকার সন্ধান।
দ্যা ইলেন ম্যাকার্থার ফাউন্ডেশনের ২০১৬ এর একটি রিপোর্ট অনুসারে, ১৯৫০ সালে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদিত হতো প্রায় ২ মিলিয়ন টন,
২০২৩ সালে যা ছাড়িয়ে গেছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন। একই বছরে বিশ্ব
ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে
প্রতি বছর প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় প্রায় ৮ লক্ষ টন, যার ৩৬-৪০% পুনর্ব্যবহৃত হয়। পরিবেশে ফেলে দেওয়া এই বর্জ্যের বাকী
অংশ জলবায়ু ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র নষ্ট করে, ধ্বংস করে
জলজ বাস্তুতন্ত। পলি ব্যাগ, বোতল, এবং অন্যান্য এককালীন ব্যবহৃত এজাতীয় পণ্যগুলি শহরের নর্দমা, খাল, এবং নদীগুলিকে ভরাট করার মাধ্যমে
দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, বাড়ায় জনস্বাস্থ্য
সমস্যা। সমুদ্রের তলদেশ থেকে আর্কটিকের বরফ কিংবা মানব রক্তেও ইদানিংকালে পাওয়া
যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি। তাই, বিপজ্জনক এই
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্লাস্টিক পণ্যের পুনর্ব্যবহার বাড়াতে হবে, বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য নিশ্চিত করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ
ব্যবহার।
মাইক্রোপ্লাস্টিক, আমাদের খাদ্য ও পানীয়ের সাথে মিশে গেছে, ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে। পোড়ানো প্লাস্টিক থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে পৌঁছাচ্ছে, সৃষ্টি করছে ক্যান্সারসহ নানা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। কঠিন এই পরিস্থিতিতে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে সার্কুলার ইকোনমির এই দুর্দান্ত অর্থনৈতিক মডেল। যেখানে মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের উপকরণকে ফেলে না দিয়ে পুনঃব্যবহার, পুনঃপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন কোনো পণ্যে রূপান্তরিত করা হয়। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেয়াদত্তীর্ণ কিংবা অব্যবহৃত প্লাস্টিক রিসোর্স বা আবর্জনাকে ব্যবহার করা হয় নতুন পণ্যসামগ্রী তৈরির উপকরণ হিসেবে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা লাভের পাশাপাশি বর্জ্য নিষ্পত্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণিজগতকে প্লাস্টিক দূষণের কবল থেকে মুক্ত করা সম্ভব।
সার্কুলার ইকোনমির প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে ইকো-ডিজাইন ও টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়া। এই কর্মসূচির আওতায় পণ্যগুলো এমনভাবে তৈরি করা হবে, সহজেই যেন এগুলোকে পুনরায় ব্যবহার করা যায়, যেখানে থাকবে মেরামত ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার সুযোগও। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য উপদান, পণ্যসামগ্রী ব্যবহারের পাশপাশি বাংলার সোনালী আঁশ, পাটকেও প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সামনের দিনগুলোতে, পাটজাত প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং ব্যবহারের বিস্তার দেশের শিল্প আর পরিবেশের মধ্যে সৃষ্টি করবে নতুন এক সেতুবন্ধন। সার্কুলার ইকোনমি মডেলটির যথাযথ বাস্তবায়নে বাংলাদেশে বাড়বে প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের হার। উন্নত রিসাইক্লিং প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে নতুন পণ্য হিসেবে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব। পুরানো বোতল থেকে নতুন বোতল তৈরি, গলিয়ে নতুন পণ্য উৎপাদনের ফলে কাঁচামালের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে, চাপ কমবে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরও।
সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্প প্রতিষ্ঠা ও তার সম্প্রসারণে প্রয়োজন যথাযথ কর্মপরিকল্পনা ও যুগোপযোগী কার্যকর নীতিমাল। পাশাপাশি তৈরী করতে হবে একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো। এই নিয়ন্ত্রক দল প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির ব্যাপারে সর্বসাধারণকে উৎসাহিত করবে। এছাড়াও ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের জন্য কর ছাড় এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যসামগ্রী উৎপানের জন্য প্রয়োজন সরকারি ভর্তুকি। প্লাস্টিক দূষণ, উপকূলীয় দেশ হিসেবে, আমাদের জন্য একটি গুরুতর হুমকি, যার ফলে প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ, হুমকির মুখে দেশের আঠারো কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। আমাদের এই দুর্দিনে সমুদ্র, নদী এবং মানবজীবনকে টিকিয়ে রাখতে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে সার্কুলার ইকোনমি। একটি টেকসই বাংলাদেশ গঠনে প্রকৃতি ও অর্থনীতি যেখানে কাজ করবে সমান্তরালে, হবে একে অন্যের পরিপূরক।
মো. রাফছান,
শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল : rafsan.cu.ac@gmail.com
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন