পরিবর্তনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, ছাত্র সমাজের আন্দোলনের ফলে দেশের রাজনৈতিক আকাশে নতুন করে দেখা দিয়েছে সম্ভাবনার ঝিলিক। ছাত্রজনতার বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ মুখে সরকার পতন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ থেকে যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল, তা পুরো জাতিকে আন্দোলিত করেছে। বিপরীতে হারিয়ে গেছে সহস্র প্রাণ, হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখো-কোটি বাঙালি জনতা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের রিপোর্ট অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ৭৮% ভোটার নির্বাচনী সুশাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, একটি নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ঘোষিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল্য লক্ষ হবে দেশের সর্বস্তরে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করা। সরকারবিহীন এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে গ্রহণ করতে হবে বহুমুখী পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়, জিডিপি হ্রাস করে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ফেলে নেতিবাচক প্রভাব। এমনই এক প্রেক্ষাপটে, অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা এবং সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও পরবর্তি নির্বাচনে যেন প্রকৃতপক্ষে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে এবং গণতন্ত্র জয়যুক্ত হয় সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে যে দেশের ৮৫% জনগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করে। জনগণ প্রত্যাশা করে অন্তবর্তীকালিন সরকার চলমান সহিংসতা শক্তহাতে মোকাবেলা করবে। প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি পরিবর্তন করবে গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক নীতি ও আইন।
দুর্নীতি-মুক্ত প্রশাসন, রাজনীতি-মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে অন্তবর্তীকালিন সরকারের সারাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী, ৪০% শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দ্বারা প্রভাবিত। ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের পাশাপাশি অন্তবর্তীকালিন সরকারকে বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সম্পৃক্ততা নির্মূল করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে বাস্তবিক, জীবনমুখী, কারিগরি শিক্ষার প্রচলন করতে হবে যা শিক্ষার্থীদেরকে চলমান বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরও দক্ষ হিসেবে প্রস্তুত করবে। একটি নিরাপদ বাংলাদেশ তৈরি করতে দেশ থেকে দুর্নীতি ও স্বৈরাচার চিরতরে বন্ধ করতে হবে। গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০২৪ এর মতে, বাংলাদেশ ১৬৩ দেশের মধ্যে ৯৩তম স্থান অর্জন করেছে, যা বিগত সরকারের আমলে দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার জানান দেয়। অন্তবর্তীকালিন সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে যাতে পুরপুরিভাবে দেশের রাজনৈতিক সহিংসতা রোধ করা যায়, নিশ্চিত করা যায় নাগরিকদের ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি সুস্থ গণতন্ত্রের অংশ। ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ১৬২ তম স্থান অর্জন করেছে, যা দেশের সংবাদ মাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অন্তবর্তীকালিন সরকারকে এই মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষা করতে হবে, যেন দেশের নাগরিক ও মিডিয়াগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। বর্তমান বাংলাদেশে কৃষির আধুনিকায়ন এবং শিল্প ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। পুরনো পদ্ধতির বিলুপ্তকরণ এবং প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তির দুষ্প্রাপ্যতা দূর করে দুর্যোগ সহনশীল ও অধিক ফলনশীল ফসলের চাষ বাড়াতে হবে। অন্তবর্তীকালিন সরকারকে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রবর্তন এবং কৃষি ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নত করতে হবে। এছাড়াও, শহরাঞ্চলে শিল্পকারখানার জনঘনত্ব কমিয়ে উৎসাহিত করতে হবে আঞ্চলিক উন্নয়ন।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সুবিধা জরিপ ২০২২ বলছে, মাত্র ৩৮% পাবলিক স্বাস্থ্য সুবিধা মৌলিক সেবা প্রদান করতে সক্ষম। অন্তবর্তীকালিন সরকারকে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি, চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রান্তিক পর্যায়ে এই সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে নাগরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কমিয়ে সর্বসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জুন ২০২৪ সালে ৯.৭% মুদ্রাস্ফীতি হার রিপোর্ট করেছে, যা দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় ফেলছে বহুমাত্রিক প্রভাব। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ চেইন উন্নতকরণ এবং প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য সাবসিডি পরিচালনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ, দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রেখে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রতিরোধ করতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা গণতান্ত্রিক শাসনের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। বিশ্ব বিচার প্রকল্প রুল অব ল ইনডেক্স ২০২৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৪০ দেশের মধ্যে ১০৫ তম স্থান অর্জন করেছে। অন্তবর্তীকালিন সরকারকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। গণতান্ত্রিক অখণ্ডতা রক্ষা ও সর্বত্র ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নিশ্চিত করতে হবে সুষম আইন, সমান অধিকার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬২% পাবলিক সেক্টরের কর্মীরা দুর্নীতির সাথে জড়িত। অন্তবর্তীকালিন সরকারকে প্রসাশনিক ক্ষেত্রগুলোতে স্বচ্ছতা বাড়াতে স্বাধীন নজরদারি সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিতে হবে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ। এছাড়াও পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন ও সময়োপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন অন্তর্বতীকালিন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং তাদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, ৭৪% নাগরিক মনে করেন যে সরকারী সিদ্ধান্তে তাদের মতামত শোনা হয় না। সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে, আয়োজন করতে হবে উন্মুক্ত আলোচনা, সভা, সেমিনার, টাউন হল মিটিং এবং পাবলিক কনসালটেশন। আশাকরা যায়, আগামি দিনে নাগরিকদের মতামতকে মূল্যায়ন করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা বাংলাদেশে একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
বিশ্বব্যাংক তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রবাসি শ্রমশক্তির মাত্র ২৫% আনুষ্ঠানিক ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ পায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে অন্তবর্তীকালিন সরকারকে প্রবাসিদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সুবিধায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এছাড়াও, প্রবাসীদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি তাদের সবরকমের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আধুনিকীকরণ করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, কেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতি বন্ধ করা গেলেই চাকুরি পরবর্তি সময়ে মানুষ আর ঘোষ নিবে না, অবৈধভাবে বার্তি অর্থ উপার্জনের তাড়া অনুভব করবে না কেউ। প্রয়োজনে বেতন বাড়িয়ে দিন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন, দিন পারফরমেন্স অনুযায়ী পদোন্নতি। সব রকমের চাকুরি ব্যবস্থার সংস্কার, যুগোপযোগীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ দুর্নীতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কর্মক্ষেত্রগুলোতে কাছাকাছি মানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সরকারি চাকুরির প্রতি মানুষের একমুখী প্রতিযোগীতা বন্ধ করা সম্ভব। সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তাবায়ন নিশ্চিত করা গেলে অচিরেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে।
জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অ-সাম্প্রদায়িক এবং একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জন্য সবাইকে নিজনিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। বৈষম্য এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দূরীকরণ, সংখ্যালঘু অধিকার সুরক্ষা এবং সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে প্রয়োজন রাষ্ট্র ও জনগনের সম্মিলিত উদ্যোগ। সামনের দিনগুলোতে দেশের মধ্যকার চলমান দুর্নীতি, বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি তাদেরকে দেশের মাঝে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে তাদেরকে বাস্তবায়ন করতে হবে জনসাধারণের বহুমুখী প্রত্যাশা। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন এবং জনগণের চাহিদাগুলির প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে, অন্তবর্তীকালিন সরকার একটি বৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে এমনটাই আশা করছে আঠারো কোটি সাধারণ মানুষ।
মো. রাফছান,
শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন