ভর্তি পরীক্ষার নামে মুখস্থবিদ্যার লটারি জেতাই সাফল্য নয়





ছুটির দিন, শুক্রবার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। ময়মনসিংহের জামালপুর থেকে আসা কানিজ ফাতিমা তার ক্লান্ত বাবার হাত ধরে চবির কাটা-পাহাড় রাস্তা ধরে শহীদমিনারের দিকে হাটছে। মেয়েটার পরীক্ষা দিনের ২য় সিফ্টে, দুপুর ২:১৫ মিনিটে। ভদ্রলোক মেয়ের পরীক্ষার জন্য ৪১৭ কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়ে আজ সকালেই ক্যাম্পাসে পৌঁছেছেন। ক্লান্ত দেহ, জীর্ণ শরীর। তবুও দীর্ঘপথের ভ্রমণক্লান্তি আর মাংশল কাঁধের ভারী বোঝায়ও তার ক্লান্ত না হয়ে যাওয়ার কি আপ্রাণ চেষ্টা! তিনি ভেঙ্গে পড়লে মেয়েকে দেখবে কে। বড় কথা মেয়ের মনোবল দৃঢ় রাখতে ভদ্রলোক তার মনোবল ধরে রেখেছেন, ধরে রাখবেন যেকোনো মূল্যে। মরবার আগে যেন এটাই তার সর্বপ্রথম ইচ্ছা। 

আমি ভাবছি, ভর্তি পরীক্ষার কথা। মেয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জন্য তিনি কতটাই না ত্যাগ করেছেন, কত গভীর ভাবেই না দোয়া চেয়েছেন মসজিদ, মন্দিরে। নিজের পরিশ্রমের অর্থ, মূল্যবান সংক্ষিপ্ত সময়, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে কত ভালোবাসা থেকেই না ৪১৭ কিলোমিটার টেনেছেন প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের ভারী বোঝা। ভর্তি পরীক্ষার কয়েকমাস পূর্বে মেয়েকে শহর বন্দরে কোচিং করিয়েছেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পড়িয়েছেন ১০১ টা বই। ব্যস্ত ঢাকার নিষ্ঠুর শহরে মেয়েকে নিয়ে দৌড়েছেন পথের পর পথ। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ খরচ করেছেন জলের মত। গত ২০ টা বছরে মেয়েকে ভালো রাখার জন্য, মেয়ের ভালো থাকার জন্য কত কিছুই না করেছেন তিনি। সময়-অসময়ে অর্থ-পরিশ্রমে পূরণ করেছেন ছোট্ট মেয়ের ভালোবাসার যাবতীয় ঋণ। বহু বছর আগেই নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়েছেন পরিবারকে একটু ভালো রাখার জন্য, পছন্দ-অপছন্দ ধুয়ে ফেলেছেন বানের জলে। 

একটা সময় হয়তো ফাতিমার ফলাফল প্রকাশিত হবে। মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেতেও পারে আবার নাও পেতে পারে। যদি সুযোগ পায় তাহলে ফাতিমার বাবার এই ত্যাগ, পরিশ্রমের মাত্রাও বাড়বে নিশ্চিতভাবে। নিয়ম করে বাড়বে মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পাওয়ার এই প্রাপ্তির আনন্দ। দীর্ঘপথের ভ্রমণক্লান্তি আর পরিশ্রান্ত দেহের ঝরা-জীর্ণতা কেটে যাবে নিমিশেই। স্বপ্নেরা পাবে নতুন পথ, পাবে আগামির পথে আরও একটু পথ এগিয়ে চলার শক্তি। কিন্তু, যে মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে না, জায়গা পাবে না সেরাদের সেরা তালিকায়। তার কি হবে? কেমন হবে ৪০০-৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া ঐ বাবাদের অবস্থা? যারা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের জন্য এত কিছু করেছেন। মেয়ের ভালো থাকায় যে বাবারা নিজের সুখ-শান্তিকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। কেমনই বা হবে সেই পরিবারের মানুষগুলোর অবস্থা, যারা এক বিন্দু আশা নিয়ে বাপ-মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন স্বপ্ন জয়ের উদ্দেশ্যে।

জানি, একটু একটু করে ঐ বাবাদের বুকের উপর বড় হবে ব্যর্থতার পাহাড়। তাদের ক্লান্ত-নিস্তেজ দেহ চষে খাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেয়ের ভর্তি না হতে পারার অপ্রাপ্তি, অভিভাবকদের রাতের ঘুর কেড়ে নিবে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। ছিড়ে ফেলা ফুলের মত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই একটু একটু করে চুপসে যাবে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া মেয়েটি। নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে একটু একটু করে পাড়ি জমাবে অন্ধকার দুনিয়ায়। চারপাশের মানুষের নেতিবাচক মন-মানসিকতায় একটু একটু করে নিভতে শুরু করবে ঐ মেয়েটির জীবনের আলো। প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেয়েটা কি অপরাধ করেছে? নাকি স্বপ্ন দেখে অপরাধ করেছিল ৪১৭ কিলোমিটারের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মেয়েকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে নিয়ে আসা বাবা? নাকি যত সমস্যা আমাদের সিস্টেমেই! যে সিস্টেমে মূল্যায়ণ করা হয় না প্রকৃত মেধাবীদের, যেখানে উঠে আসেনা সত্যিকারের জ্ঞানী। যে সিস্টেমে সীমিত অসন সংখ্যার অজুহাতে ছেঁটে ফেলা হয় অসংখ্য মেধাবীদের। সহজ-কঠিন প্রশ্নের মারপ্যাঁচে যেখানে প্রায়শই হেরে যাচ্ছে তরুণ মেধাবীরা, হেরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় তরুণ কানিজ ফাতিমারা।

৭১ পরবর্তি ৫০ বছরে কত লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়েরা দেশের খ্যাত-অখ্যাত, ছোট বড় অসংখ্য সরকারি, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেলো, পড়াশোনা করলো। কই, মানুষ হলো কয় জনে, স্বশিক্ষিত হলোই বা আর কয় জন? এখনই বা কি শিখছে আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীরা? নিতিনির্ধারকরা আসলেই কি রকমের শিক্ষা দিচ্ছেন তাদের? এই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনার নামে টাকা পয়সা লুটতরাজের অন্ধ প্রতিযেগিতা দেশে চলছে, আদৌ কি কেউ সেটার হদিস রাখে? গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরের আনাচে-কানাচে এইযে এত এত সরকারি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার এগুলো দিয়ে আসলেই হচ্ছেটা কি? এসকল প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিবছরে ঠিক কয়টা ছেলে মানুষের মত মানুষ হচ্ছে, ভবিষ্যতেই বা আর কয় জন হবে?

শুধু শুধুই নামকাওস্তে ভূয়া পাসে শিক্ষার হার বৃদ্ধির এই চুর পুলিশ খেলায় ১ অনুচ্ছেদ কিংবা ১ রাতের পড়াশোনায় পার পেয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে বুঝে ওঠার আগেই। কিছু ক্ষেত্রে তারা সুযোগ পাচ্ছে না, কিছু ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সুযোগ উপেক্ষা করছে হেলা-অবহেলায়। নিয়ম করে প্রতিবছরই এই সিস্টেমের বলি হচ্ছে হাজারও সম্ভবনাময় শিক্ষার্থী, ভর্তি পরীক্ষার ব্যর্থতা মেনে নিতে না পেরে অনেকেই অল্প বয়সে হারিয়ে ফেলছে জীবনের উইকেট। দেশের প্রতিটা কানিজ ফাতিমাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গালে এক একটা চপেটাঘাত, য়ারা নিজেরা নিঃম্ব হয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায় আমাদের দুর্বলতা, অজ্ঞতা আর উন্নয়নের জায়গা। তাদের এই ব্যর্থতা, অজ্ঞতার দায় কেবলই তাদের পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নয়, দায় রয়েছে রাষ্ট্রেরও। শিক্ষা ব্যবস্থার অসম প্রক্রিয়া, বাস্তবিক শিক্ষার অভাব, মুখস্থবিদ্যার অন্ধ প্রতিযোগিতার আড়ালে এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাজারও ফাতিমার জীবন। 

বহুনির্বচনী প্রশ্নের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধার মূল্যায়ণ করা যায় না। ৬০ মিনিটের ছোট্ট পরীক্ষাতেই বুঝা যায় না একটা শিক্ষার্থীর উপস্থাপন কিংবা মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা জ্ঞানের পরিধি, জানার গভীরতা। মেধার মূল্যায়ণ অবশ্যই সামগ্রিক হওয়া উচিৎ। যেখানে বহুনির্বচনী প্রশ্নের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে যথাক্রমে প্রাথমিক জ্ঞান ও বিশ্লেষণ দক্ষতা যাচাই করা যাবে। যেখানে ওঠে আসবে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা। অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার নামের মুখস্তবিদ্যার এই লটারি বন্ধ করে প্রকৃত মেধাবীদের খুঁজে বের করার সময়োপযোগী পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। সিফ্ট ভিত্তিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে হবে সিফ্ট ভিত্তিতেই। বহুনির্বচনীর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করতে হবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি। অনুষদ ভিত্তিক বিষয়ের জন্য নিতে হবে ঐ নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত বিষয়ের উপর পরীক্ষা। 

ভর্তির পরীক্ষার নামে মুখস্থবিদ্যার এই লটারিতে হেরে যাওয়াই জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেলে কারো জীবন থেমে থাকে না, থেমে থাকে না আশেপাশের প্রকৃতি-প্রিয়জনও। নিজের সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রস্তুত করুন, ন্যায়-নীতির শিক্ষা দিন। বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সন্তানের প্রকৃত মানুষ হওয়ার নীতি-নৈতিকতাই সাফল্যের পথে তাকে এগিয়ে দিবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মনিষ্ঠা আর স্বীয় মানবিকতাই তাকে পৌঁছে দিবে সাফল্যের সর্বোচ্চ শেখড়ে। তখন আর কেউ তাকে আটকে রাখতে পারবে না। এক পৃথিবী ব্যর্থতা পেছনে ফেলে সে মাথা তুলে দাঁড়াবে সূর্যের মত, এগিয়ে যাবে আলোর গতিতে।

মোঃ রাফছান
শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন