বাংলাভাষার বিকৃতি ও ভবিষ্যৎ




সংযোজন, বিয়োজনে আবিরাম বয়ে চলা ভাষা বহতা নদীর মতো চঞ্চল। নিত্য পরিবর্তনের এই ভাঙা-গড়ার মিছিলে বর্তমান সময়ে টিকে থাকা সাড়ে ৩ হাজার ভাষার মধ্যে অন্যতম একটি বাংলাভাষা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত প্রায় ৩০ কোটি মানুষ নিত্যদিনকার ভাব বিনিময়ে বাংলা ব্যবহার করে। এই বাংলাভাষার দাবিতেই ৫২ এর ফেব্রুয়ারিতে ঘাতকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল সালাম, রফিক, জব্বারদের আঠারো পেরুনো সোনার শরীর, মাংশল বুকে জায়গা নিয়েছিল চারু খচিত জীবননাশক লৌহ বুলেট। তাদের তাজা রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা, বাংলা পরিণতি পেয়েছিল মাতৃভাষায়, পেয়েছিল রাষ্ট্রিও এবং বৈদেশিক স্বীকৃতি।

সাহিত্য, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাংলা আজ হারাতে বসেছে তার রক্তার্জিত মহাত্ম, জীবনের বিনিময়ে অর্জিত মূল্যবোধ। নতুন প্রজন্মের ইংরেজিপ্রীতি, বাংলা চর্চায় অনুৎসাহ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে আমার ভাষাবোধকে ভীষণ ভাবে পৃষ্ট করে। জন্মলগ্ন থেকেই বহু ত্যাগ, তিরস্কারে অর্জিত বাংলাভাষার আজকের এই বেহাল দশায় কর্তৃপক্ষের নেই বিন্দুমাত্র উদ্বেগ, ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কারোরই নেই স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়েও ক্রমেই বাড়ছে সর্বস্তরে মাতৃভাষাকে সম্মানজনক স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে না পারার আশাভঙ্গের দুঃখ। মার্কেট, প্রযুক্তি, দক্ষতায় ইংরেজি জানা প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। বিপরীতে কোথাওই সৃষ্টি হয়নি বাংলাভাষায় জ্ঞানচর্চার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের ন্যূনতম ধারাবাহিকতা। 

সন্তানদের শিক্ষাদানের প্রশ্নে বিত্তবানদের বাংলা ছেড়ে ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে ঝুঁকে পড়ার জবড়জঙ্গ অসুস্থ ধারায় ক্রমেই মর্যাদা হারাচ্ছে আমাদের আবেগের ভাষা। শহরতলির ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের সংখ্যার প্রাচুর্যে প্রতিনিয়তই সংকোচিত হচ্ছে বাংলাভাষার কালচার। ফলাফলে তৈরি হয়েছে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বাংলা লিখতে-পড়তে না জানা তথাকথিত ‘স্মার্ট’ প্রজন্ম। বিত্তবান পরিবারগুলোর ইংরেজিপ্রীতি আর বাংলা বিমুখতায় এই বাংলার বুকেই ধীরে ধীরে কমছে অভিজাত বাঙালী পরিবারের সংখ্যা। উচ্চ পারিশ্রমিকের চাকুরি, রেডিও, টেলিভিশন, ব্যবসা-বাণিজ্যে এই বাংলার দেশেই বাড়ছে ইংরেজির কদর, বাংলা ক্রমশই পরিনত হচ্ছে গরিবের ভাষায়। বাংলাভাষার জ্ঞান ও দক্ষতা সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে না পারায় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের কাছে ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে বাংলাভাষা। ইংরেজী না জানার মহাদণ্ডে একদল বাঙালিদের জন্য এই বাংলার দেশেই সঙ্কুচিত হচ্ছে চাকুরির বাজার কিংবা উচ্চশিক্ষার দরজা। উদার অর্থনীতির এই আধুনিক যুগে দেশে এখন বিদেশি কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে, দিগুণ হারে বেড়েছে ইংরেজির কদরও। জীবিকার তাগিদে সচেতন নিরুপায় বাঙালি তাই মুক্তমনেই ঝুঁকছে ইংরেজির পিছু। 

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই বাংলাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিজ্ঞজনেরা। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরেও সুপ্রীম কোর্টেই নিশ্চিত হয়নি বাংলাভাষার সর্বোচ্চ ব্যবহার। আকাশ সংস্কৃতির এই আধুনিকতার যুগে দেশে বাতাসের ন্যায় ছড়িয়েছে ভাড়া করা হিন্দি সংস্কৃতি। বাংলার বুকে ইংরেজী ক্যান্সারের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সর্বনাশা হিন্দি ক্ষত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন আর বেতার মাধ্যমগুলোতে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া বাংলাভাষায় ইংরেজী শব্দের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ভাষার বিকৃতির কারণে অচীরেই দেখা যেতে পারে বাংলাভাষার অস্তিত্ব সংকট। ফেইসবুকে ক্ষুদে বার্তায় বাংলাভাষাকে ইংরেজিতে লেখা নিরক্ষর-অর্ধ শিক্ষিত তারুণ্যের বাংলা বিকৃতি আর বিত্তবানদের বাংলা ছেড়ে ইংরেজী চর্চার অপসংস্কৃতি এভাবে নির্বিবাদে চলতে থাকলে অচিরেই হারিয়ে যাবে বাংলাভাষা।

বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষায় টেলিভিশন, রেডিও এবং সংবাদমাধ্যমগুলোতে  আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের বিজ্ঞাপনে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে হবে। দেশের গ্রামীণ ও শহরতলীর সকল শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামফলকে বাংলাভাষার ব্যবহার খুলে দিতে পারে মাতৃভাষার নতুন দিগন্ত। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে নিশ্চিত করা হোক বাংলাভাষার সর্বোচ্চ ব্যবহার। নাটক, সিনেমা আর টেলিভিশনের স্বল্প কিংবা দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের অনুষ্ঠানে অভিনয়, টকশো, উপস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সঠিক, নির্ভুল বাংলা বলা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম, টেলিভিশন, ফেইসবুক এবং ইউটিউবের মত মাধ্যমগুলোতে বাংলা ভাষার বিকৃতি রুখতে, বাংলাভাষায় অন্য ভাষার শব্দের ব্যবহার কমাতে সরকারী-বেসরকারি পর্যায়ে যথোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাভাষার ইতিহাস ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখাতে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ভাষাবোধ এবং বাংলা ভাষার শুদ্ধ এবং সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে সভা-সেমিনারগুলোতে বাংলাভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য, গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। 
অনতিবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অফিস-আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে নেওয়া প্রয়োজন বাংলাভাষার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ। সুপ্রিমকোর্টসহ দেশের সকল শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত বাংলা চর্চা নিশ্চিত করা গেলে অদূরেই বাংলাভাষা ফিরে পাবে তার অধুনা যৌবন, ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। 

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায়, বাংলা ভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে শিক্ষা ও উন্নয়নে বাংলাভাষাকে সম্পূর্ণরূপে মূল্যায়ন করা দরকার। বাংলাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সংরক্ষণ করা দরকার মাতৃভাষার স্বকীয়তা, নিজস্বতা ও আত্মপরিচিতি। বৈশ্বিক বাস্তবতায় সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় ফরাসি, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানিদের মত বাঙালিরাও হয়ে ওঠুক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার বাংলায় দেওয়া ভাষণ এবং বাংলাকে জাতিংসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি বিশ্বদরবারে বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করুক, বাংলা পাক প্রাপ্য স্বীকৃতি। বিজ্ঞান বিস্ময়ের এই ইংরেজির যুগে বাংলা থাকুক বাঙালীর জীবনপ্রবাহে, নিত্যদিনের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের সংকট, সংকোচ, বোঝাপড়ায়, চীরকাল টিকে থাকুক আমাদের আবেগের ভাষা হয়ে। পাশাপাশি ইংরেজীও থাকুক আমাদের কাজ কিংবা অর্থ উপার্জনের ভাষা হয়ে।

মোঃ রাফছান 
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন