জীবনের তাগিদে মাঠে ফিরোক প্রয়োজনের ফুটবল





জীবন থেকে পুরো একটা দশক হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন। ক্রিকেটে ভালো কিপিং করতাম আর ফুটবলে ছিলাম প্রথমিক বিদ্যালয়ের গোলরক্ষক, ছিলাম ভরসার সর্বশেষ স্তম্ভ। পড়াশোনার ফাঁকে, মধ্যবিরতি কিংবা স্বল্প অবসরেই নেমে জেতাম বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠে। গা গরমের খেলায় জয় পরাজয় তো থাকতোই। সেবার ভালো খেলার ফলাফল স্বরূপ উপজেলা পর্যায়েও আমরা ভালো করতে পেরেছিলাম।


তারপর সমাপনী দিয়ে আসি মাধ্যমিকে। বড় ক্লাস, পড়াশোনা বেড়েছে, তাগাদা কমেছে মাঠের ফুটবলে। স্কুল থেকে ক্রিকেট, ফুটবলে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে নেই কোন অংশগ্রহণ। ফলে ভাটা পড়লো আমাদের খেলায়, আমাদের ফুটবলে। তারপরেও নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে টুকটাক কয়েকটা ম্যাচ হতো দীর্ঘ বিরতিতে। পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ব বলে, সব কিছু থাকার পরেও স্কুল থেকে সরবাহ করা হতো না খেলাধুলার যাবতীয় সরঞ্জাম। স্কুল পালিয়ে খেলার অপরাধে জন্মের মার খেয়েছিলাম একদিন! সেই যে ফুটবল ছেড়েছি, ক্রিকেট ছেড়েছি, কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে দ্বিতীয় বার আর খেলা হয়ে ওঠেনি।

বলছিলাম আমাদের ফুটবলের কথা, আমাদের ক্রিকেটের কথা, পড়ালেখার পিছনে ছুটতে গিয়ে আমরা কিভাবে হারিয়ে গেছি নিয়মের খাদে, আশা-প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে কিভাবে বলি দিয়েছি ফুটবল কিংবা ক্রিকেটের স্বপ্ন। যে খেলাধূলার সূচনাই ছিল শরীর গঠন, শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখা, সুস্বাস্থ্য অর্জন।

কথা হচ্ছে, হাতের বল, পড়নের জার্সি কেড়ে নিয়ে আসলেই কি একটা ছেলেকে বইয়ের লেখায় দিক্ষা দেওয়া যায়? নাকি খেলাধুলাটা জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটা প্রজন্ম বড় হয়ে গেছে ক্রিকেট, ফুটবলকে উপেক্ষা করেই। পড়ালেখার তাগাদায় যারা হারিয়েছে তাদের দূরন্ত শৈশব।

একটা মানুষ শুধু পড়ালেখাতেই বাঁচে না, স্যার। মানুষের বেঁচে থাকায় প্রত্যেকটা মৌলিক চাহিদাই প্রয়োজন সমান অনুপাতে, ভাতের খুদা ভাতে মিটলে ফুটবলের খুদা মিটবে ফুটবলেই। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ছাত্রদের খেলাধুলায় নিরুৎসাহিত করার এই ধর্ম কালক্রমেই চলছে, কারোরই নেই এ বিষয়ে সময় উপযোগী ভাবনা। পড়ালেখাটা গুরূত্বপূর্ণ কিন্তু পড়ালেখাটাই সব না। বাঁচতে হলে পড়তে হবে, খেলতেও হবে।

এই যে অবহেলায়, নিরুৎসাহে পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই এই প্রতিভা গুলো নিঃশব্দে, নিরবে হারিয়ে গেল তার খবর কি কেউ রেখেছে? বাবা মায়ের বাক-বিতণ্ডা কিংবা বেত্রাঘাতের ভয়ে যে ছেলে গুলো নিজের স্বপ্ন ভুলেছে, খেলা ছেড়েছে, দিনশেষে এই মানুষগুলো কি আসলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? কিংবা নিজের স্বপ্ন মাটি চাঁপা দিয়ে মা-বাবার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে? পারেনি। অথচ যদি এরা ফুটবলে সময় দিত, ক্রিকেটে সময় দিত, তাহলে হয়তো ভিন্ন কিছু হতে পারত, ক্রিকেট, ফুটবলে তৈরী হত আরও দুই-চারটা সাকিব, জামাল ভূঁইয়া।

দিনশেষে  ভালো কিছু পেতে প্রত্যাশার লিস্টটা ছোট করে দিন। বিপরীতে বড় করুন ভালোবাসা এবং ভালো রাখার দায়িত্বটাও, সন্তানের খুব একটা ভাল বন্ধু হয়ে যান। পূরণ করুন তার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো। দেখুন, সে কোন কাজটা ভালো করে। পড়ালেখার পাশাপাশি তাকে ঐ বিষয়টা চর্চা করার সুযোগ দিন। খেলাধুলার মাধমে সুযোগ করে দিন পূর্ণ বিকশিত হওয়ার। দিনশেষে এই সার্টিফিকেট, ডিগ্রির আসলেই কোনো মূল্য নেই। কেবল যোগ্যতার বলেই সবাই টিকে থাকে, থাকবে। টিকে থাকার এই যুদ্ধে আপনার সন্তানকে প্রস্তুত করুণ যোগ্যতম হিসেবেই। তাহলেই সমৃদ্ধ হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, সমৃদ্ধ হবে আমাদের দেশ, সমৃদ্ধ হবে আমাদের হারানো ঐহিত্য, সমৃদ্ধ  হবে আমাদের ফুটবল, আমাদের ক্রিকেট।

 "দুর্বল মস্তিষ্ক কিছু করতে পারেনা। আমাদেরকে ইহা পরিবর্তন করে সবল মস্তিষ্ক হিসেবে তৈরি করতে হবে। তোমরা সবল হও, গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের সমীপবর্তী হবে।"
-স্বামী বিবেকানন্দ।

আপনার সন্তানকে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলতে দিন, খেলাধুলা একটা মানুষের শারীরিক সুস্থতা, অন্তহীন আনন্দ, মানসিক প্রশান্তির নিশ্চায়ক। ব্যাক্তি, পারিবারিক কিংবা জাতীয় জীবনে শক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় খেলাধুলার মাধ্যমে অর্জিত এই সুঠাম, স্বাস্থ্যবান, নিরোগ দেহ, ললাট দেশে এঁকে দেয় সাফল্যের জয় তিলক! খেলাধুলার মাধ্যমেই নিশ্চিত হোক একটা সুস্থ, সুন্দর বহুমুখী প্রতিভার দূরদর্শী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যাদেরকে ঘিরে বাস্তবায়িত হবে আমাদের হরেক রকমের আশা ও প্রত্যাশা।

মোঃ রাফছান 
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন