ইসলামের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আল কুরআন, আর এই মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এর পবিত্রতা রক্ষায় হাজারটা জীবন অনায়াসে দিতে পারে মুমিনগণেরা। এক অজ্ঞাত কুচক্রী মহল কর্তৃক সংগঠিত, মন্দিরে কুরআন অবমাননার ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া গর্হিত কাজগুলোর অন্যতম একটি। আর, মন্দিরে কুরআন আনা এবং মূর্তির পায়ে কুরআন রাখার মত এই অপকর্মের দ্বায় মন্দির কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই অস্বীকার করতে পারে না! অতি সেন্সেটিভ এই ধর্মীয় বিষয়টাকে মন্দিরে হতে দেওয়ার অনুমোদনেই মুসলিমরা ফুঁসেছে এবং মুসলিমদের পক্ষে এই ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। কেবল, হিন্দু বলেই নয়, এরকম ঘটনায় যেকোনো মানুষ, যেকোনো ধর্মের বিপক্ষেই ধর্মপ্রবণ জনতা জিহাদ করবে। এটা কোনো চক্রান্ত কিংবা যাইহোক, তবে অন্তত মন্দিরে কুরআন অবমাননার মত এরকম অপকর্ম হতে দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া কোনো ভাবেই উচিৎ হয়নি।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, কুরআন অবমাননার এই ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার পরিবর্তে অন্য আরেকটা অজ্ঞাত চক্রের সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যাচ্ছে। যাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দু - মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া কিংবা এই অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে স্বীয় উদ্দেশ্য চীরতার্থ করা এবং এই ঘটনায় তারা সম্পূর্ণরূপে সফল। তাদের এই অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে তারা ব্যবহার করছে একদল ধর্মান্ধ, বেতাল বাঙালী, যারা জানেই না প্রকৃত অপরাধী কারা, জানেই না কোন কুচক্র এই সার্বিক সমস্যা, গোলযোগের প্রকৃত জন্মদাতা! ধর্মান্ধ এসব বাঙালী তাদের এই কুচক্রে পা দিয়ে ইসলামের নামে বুলি আওড়াচ্ছে, অমুসলিমদের নামে ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে পথে প্রান্তরে, প্রচণ্ড ক্রোধে পুড়িয়ে দিচ্ছে নিরীহ সনাতন ধর্মালম্বীদের মাথা গোজার একমাত্র ঠিকানা, একের পর এক ধ্বংস করছে বিধর্মীদের ছোট-বড় উপাসনালয়। প্রকৃত অর্থে এতে আদোও কি কুরআন অবমাননাকারীদের কিছু হচ্ছে? কোনো ভাবে ফিরে পাওয়া যাচ্ছে কুরআনের সম্মান? কোনোরূপ ধরা-ছোঁয়ায় এসেছে পর্দার আড়ালের ঐ গুপন কুচক্র?
সুকৌশলে ঐ অজ্ঞাত কুচক্র মুসলিমদের ইসলামের প্রতি অকাতর ভালোাবাসা, ত্যাগ, ধর্মপ্রীতি এবং দুর্বলতাকে ব্যবহার করে হাসিল করে নিচ্ছে আপন আপন উদ্দেশ্য। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের অবশ্যই মনযোগ দিয়ে ভাবা উচিৎ, প্রকৃত অপরাধী আসলে কারা আর সেই অপরাধীদের পরিবর্তে আমরা শাস্তি দিচ্ছি কাদের? ইসলাম আমাদের কী শিক্ষা দেয় আর তার বিপরীতে আমরা কী করছি? অমুসলিম মানেই ইসলামের শত্রু নয়, ইসলাম ভালোবাসতে শেখায়, যদ্ধ-বিগ্রহ, ক্রোধ কিংবা ক্ষমতার দৌরাত্ম্য নয়। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পুরো জীবন জুড়ে বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের এই বিষয়গুলো শিখেয়ে গিয়েছেন। যে আক্রমণাত্নক আচরণ আমরা দোখাচ্ছি তা অবশ্যই কেবল মাত্র প্রকৃত অপরাধীদের জন্যই হওয়া উচিৎ।
হিন্দু-মুসলীমের মারপ্যাঁচে মাঝখানে ভুক্তভোগী হচ্ছে একদল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যারা ঘটনার এপারেও নেই, নেই ওপারেও। নিকট অতীতে মুসলিমরা আর যাইহোক, কখনোই হিন্দুদের শত্রু ছিল না, হিন্দুরাও শত্রু ছিল না মুসলমানদের। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের এই অসাম্প্রদায়িক দেশে পূর্বেও মানুষ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী মানুষের সাথে বহুকাল ধরে মিলেমিশে থেকেছে, সময়-অসময়ে তাদের কাছে টেনেছে, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ভালোবেসেছে, বিপদে সহযোগিতা করেছে, তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে নিঃশর্তে সর্বদা সম্মান করেছে, হিন্দু-মুসলিমের পারষ্পারিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছে। অমুসলিম মানেই শত্রু নয়, এরা আমাদের প্রতিবেশি, সমাজ, বন্ধু, পরিবার। বহুকাল ধরেই আমাদের দেশে বহুধর্মীয় এই পারষ্পারিক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন ছিল, ইনশাল্লাহ, ভবিষ্যৎ কালেও থাকবে। অদূর ভবিষ্যতে কোনো সংঘবদ্ধ চক্র এই পারষ্পারিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চাইলে সংগ্রামী জনতা প্রতি বারই তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। অপকর্মকারী জালিমদের প্রতিটা অন্যায়, অপকর্মের বিরুদ্ধে আজীবন জিহাদ করবে, সংগ্রাম করবে, যুদ্ধ করবে!
অবশ্যই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ যারা কুরআন অবমাননার এই ঘটনা ঘটিয়ে দেশব্যাপী এই অস্থিতিশীল জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে, এই কাজে মদদ দিয়েছে, এই কাজে অনুমতি দিয়েছে এবং সহযোগিতা করেছে। তাদের এমনই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ, যা দেখে ভবিষ্যৎ কালে অন্তত আর কখনোই যেন কেউ এমন অপকর্ম করার সাহস না রাখে। আর, কেউ যদি ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যাক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এই গর্হিত কাজ সংগঠিত করে থাকে তাহলে তার জন্য নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। যদিও আমাদের দেশে সঠিক বিচার পাওয়া খুবই দুষ্কর, তারপরেও অন্তত অভিযুক্ত অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি প্রত্যাশা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। আশাকরি, খুব শিগ্রই বাংলাদেশ সরকার এই অজ্ঞাত চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিবে, প্রকৃত অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির পাশাপাশি নিশ্চিত করবে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের জীবন মানের সার্বিক নিরপত্তা।
বঙ্গবন্ধুর এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে, মন্দির ভাঙ্গা এবং কুরআন অবমাননার কোনোটিই সমর্থনযোগ্য নয়, ইসলামও এই দুটো বিষয়ের কোনোটিকে সমর্থন করে না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের প্রত্যেককেই অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ করা উচিৎ এবং ইসলাম আমাদের এমনটাই শিক্ষা দেয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক আর হিন্দু সংখ্যালঘুই হোক, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মত অধিকার কেউ রাখে না। কোনো এক কুচক্রের কারণে দেশব্যাপী এই অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার কোনো মানেই হয় না। তাই, অনতিবিলম্বে ঐ কুচক্রের সন্ধান করে, চক্রের মূল হোতা কিংবা প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ধর্মপ্রবণ মুসলিম সম্প্রদায়কে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যেন আমাদের ইসলাম কিংবা ধর্ম প্রীতিকে কোনো অসৎ চক্র কিংবা কোনো অসাদু ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত হীন অভিসন্ধি কিংবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করতে না পারে। বিনা অপরাধে আর কোনো মানুষের মনে একটা আঘাতও নয়, পারষ্পারিক সম্প্রীতি বজায় রেখে সবাই মিলে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে, অস্থিতিশীল এই জুরুরী অবস্থার সুষ্ঠ মোকাবেলাই হোক সর্বস্তরের বাঙালীদের একমাত্র ধর্ম!
মোঃ রাফছান
শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন