সিলেট থেকে ঢাকা, গাড়ি পথে পুরো ১৫০ মাইলের ধাক্কা, বিমান পথে ঘন্টাখানেক, নৌপথে লাগতে পারে আরও ঘীর্ঘসময়। নিত্যদিনকার প্রয়োজন যখন দেশের প্রতিটা দুয়ারে দুয়ারে, সেখানে আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন পুঞ্জিভূত থাকে ত্রাসের শহর ঢাকায়। চিকিৎসাই নয়, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, কৃষি, মৎস্য, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির গোল টেবিল বৈঠকটাও হয় ঢাকার মাঠে।
উত্তরবঙ্গে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কৃষকের পরিশ্রমের ফসলের দরদাম করে ঢাকায় বসা কোনো মস্তবড় অফিসার। ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বঙ্গোপসাগরে আহরণকৃত মাছ বিক্রির চুলচেরা বিশ্লেষণও হয় ঢাকার কোনো অফিসে বসে। গ্রামের কৃষক, শ্রমিকের সম্পদ লুটপাটে শহর জুড়ে তৈরী হয় মস্তবড় মনসুর ম্যানশন, আরমান ভিলা কিংবা বাহারি নামের বিলাসবহুল বড়বড় টাওয়ার। গ্রামীণ সমাজ চুষে নিয়ে তপ্ত বালির বুকে থরেবিথরে নির্মিতি হচ্ছে আপন আপন সম্রাজ্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নিবিড় বার্ষিক ফসল উৎপাদন কর্মসূচির ২০১৯-২০ অর্থ বছরে শুধুমাত্র ময়মনসিংহে ১০ লক্ষ ৬৫ হাজার ৩৫০ মে. টন বোরো, ৭ লক্ষ ২৮ হাজার ৭২৮ মে. টন রোপা আমন এবং ৬২ হাজার ৬০০ মে. টন আউশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। একই অর্থ বছরেই শুধুমাত্র মুন্সীগঞ্জে উৎপাদিত আলুর পরিমাণ ১৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৭৯৫ মে. টন।
পাবনায় উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ৫ লক্ষ ৯৩ হাজার ৫২৩ মে. টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আরেকটি তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারাদেশে মোট উৎপাদিত ২৩ লাখ ৭২ হাজার টন আমের ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪৮৬ টন আমই নওগাঁ থেকে আসে। যেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসেছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টন এবং রাজশাহী থেকে এসেছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ টন।
ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য অফিস জানায়, দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১১ ভাগ উৎপাদন হয় ময়মনসিংহ জেলায়। আর পাঙ্গাশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫০ ভাগই হয় ময়মনসিংহ অঞ্চলে। সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে সাতক্ষীরা জেলায় ১১ হাজার ৬৩০টি গলদা চিংড়িঘেরে চাষকৃত ১১ হাজার ৩৮৮ হেক্টর জমিতে গলদা চিংড়ির উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।
অথচ, মৎস্য, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, চিকিৎসা, সেবা, বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে, সদরদপ্তর, গবেষণাগার, কর্মসূচী, মিটিং-মিছিল ও নিত্যদিনকার প্রয়োজনীয় কর্মসূচি পালিত হচ্ছে জনবহুল ঢাকার ব্যস্ত অলিগলিতে। ঘটনার উৎপত্তি যেখানেই হোক, দিনশেষে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ঐ ঢাকাই।
অপরিকল্পিত নগরায়ন আর অবাধ যত্রতত্র শিল্পায়নের এই ভুলের যুগে প্রাণের দাম কমেছে, কমেছে কৃষকের ন্যায্য পাওনা। আনুপাতিক হারে বেড়েছে যান চলিত যাতায়াত খরচের হিসেব, বেড়েছে স্কুল কলেজে পড়াশোনার ফীও। তুলনামূলক হারে আরও বেড়েছে সাধারনের শ্রমে গড়ে ওঠা আকাশচুম্বী আমিন ম্যানশনে রাত্রি যাপনের তাড়া। ইট কংক্রিটের উঁচু দালান, জীবনের আবহওয়া বদলায়নি, পরিবর্তন করেনি আমাদের মানসিকতার ছাঁচ।
কেবল বাড়িয়েছে মানুষে মানুষে ঘনত্ব, খুন-খারাপি, অপহরণের সংখ্যা বাড়িয়েছে, নিত্যনতুন প্রতারণার ফাঁদে আরও বাড়িয়েছে শর্বনাশের ভয়। কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত প্রবাসী রেমিটেন্সে ভোগ বিলাসের জমজমাট আসর বসিয়েছে ঢাকার ব্যাংকগুলো। আর হাসপাতাল? অর্থহীনের অনাচিকিৎসায় দ্রুতগতিতে বাড়িয়ে চলেছে লাশের সংখ্যা। বিপরীতে সাদা কালোর এই বিচিত্র পৃথিবীতে সময়ের ব্যবধানে নির্মিত হয়েছে জানা অজানা অসংখ্য টাকার পাহাড়।
ডিজিটাল পৃথিবীতে পরিবর্তিত হয়েছে মানব মূল্যায়নের ধরন, অবমূল্যায়নে রুটিন করে নির্বিবাদে কাঁটা পড়ছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় জীবন। গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুচিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়া সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দীন আহমদ বাঁচাতে চেয়েছিলেন, বাঁচতে চেয়েছিলেন। অসুস্থ পৃথিবীর ক্রান্তিপর্বে যখন ডা. মঈন উদ্দীন আহমদকে পৃথিবীর বড্ড বেশিই প্রয়োজন সেখানে অবহেলার দুর্বাচলে আমরা মাটিচাপা দিয়েছি ডা. মঈন উদ্দীন আহমদের নিষ্প্রাণ দেহ।
আজ ডা. মঈন উদ্দীন আহমদ নেই, নেই একই পেষার অন্যান্য ডা. মঈন উদ্দীন আহমদরাও, যারা প্রাণের দামে দিয়ে গেছেন অপরিকল্পিত বিশৃঙ্খলার নতুন সমাধান। এই লাশের দ্বায়ভার কার? পরিকল্পিত সাম্যের নগরায়নে যদি সিলেটেও একটা ''ঢাকা মেডিকেল" থাকত, আনুপাতিক হারে সিলেটেও থাকত যদি সদর দপ্তরের সংখ্যা, মানুষ ঢাকায় না গিয়ে জীবনের তাগিদে সিলেটে ছুটলে ডা. মঈন উদ্দীন আহমদকে হয়ত উন্নত চিকিৎসার অভাবে এভাবে জীবন বায়ুর বিসর্জন দিতে হতনা। ফলাফলে বেঁচে যেত আরও কিছু নির্বিবাদী অসহায়ের প্রাণ। হাসি খুশির আনন্দ ফিরে পেত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা মানুষটার পিয়জনের মুখ।
মৃত লাশ সংখ্যায় বেড়েছে ঠিকই, সমহারে দেখিয়েছে সমাধানের পথ। অপরিকল্পিত নগরায়নের মৃত্যুর মিছিল দমাতে এখন সময় সুষ্ঠু, গভীর, সুপরিকল্পনার, সমান সুস্বাস্থ্যের, সুষম শিল্পায়নের। যেখানে ঢাকাতেই নয় প্রতিটা বিভাগীয় শহরেই নির্মিত হবে এক একটা 'ঢাকা মেডিকেল'। উৎপাদন কেন্দ্রেই হবে উৎপাদিত পণ্যের জ্ঞান, গবেষণা, ঢাকা থেকে সরিয়ে উৎপত্তিস্থলের আশেপাশেই নির্মিত হবে উক্ত পন্যের সদর দপ্তর।
এতে করে মানুষে মানুষে ভোগান্তি, দুর্ভোগ কমবে, পরিশ্রমের নৈপথ্যে সাধারনের মিলবে প্রাপ্য মূল্যায়ণ। নিরসন হবে অপরিকল্পিত যানজট সমস্যা, কমবে ছিনতাই, রাহাজানি অহরণের খবরে ভরা পত্রিকার পৃষ্ঠাও। ফলাফলে জ্যামিতিক হারে আরও বাড়বে কর্মসংস্থান, কিংবা অসহায়া পরিশ্রমী সমাজ পাবে জীবন মানের পর্যাপ্ত মূল্যায়ণ।
করোনার এই ক্রান্তিপর্বে ডানা মেলুক বেঁচে থাকার নতুন কোন দুর্বোধ্য সমীকরণ। বিবেকের আইসিউতে আরও একবার পরিশুদ্ধ হোক কৃষ্ঞকায় নষ্ট হৃদয়। লকডাউনের এই দুর্বিষহ করুণ সময় নতুন করে জানতে শিখাক প্রয়োজন বোধ, শিখিয়ে দিক অস্থিতিশীল জুরুরী দূরাবস্থায় টিকে থাকার কোন অভাবনীয় কলাকৌশল। এই পাপের ঝড়ে ধুয়ে যাক মনের ঘরের গাঢ় অন্ধকার। দুঃসময় পেরিয়ে বেঁচে থাকুক নির্বিবাদী, সত্যনিষ্ঠ অসহায় প্রতিবেশী সমাজ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন