বাংলাদেশে এল নিনোর আর্থ-সামাজিক প্রভাব



ল নিনোর উৎপত্তি গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরেযেখানে মহাসাগর এবং বায়ুমণ্ডলের মধ্যে পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে জটিল জলবায়ু প্যাটার্ন সৃষ্টি হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক আবহাওয়া চক্র যা নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার পর্যায়ক্রমিক উষ্ণতা (এল নিনো) এবং শীতলকরণ (লা নিনা) হিসেবে পরিচিত। এল নিনোর অপ্রত্যাশিত এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণে বর্তমানে পৃথিবি জুড়ে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

এর প্রভাবে নিরক্ষীয় অঞ্চলের স্বাভাবিক পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হওয়া বাতাসের দিক পরবর্তিত হয়। মূলতএল নিনোর বছরগুলোতে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিক অর্থাৎ উত্তর আমেরিকার পেরুচিলি অঞ্চল থেকে আসা বাণিজ্য বাতাসের শক্তি কমে যাওয়ার ফলেপশ্চিম তথা অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল থেকে একটি অপেক্ষাকৃত উষ্ণ বায়ু প্রচুর জলীয়বাষ্প নিয়ে নিরক্ষীয় অঞ্চলের পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে স্থানান্তরিত হয়যা উত্তর আমেরিকার পেরুচিলি অঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রা ও নিম্নচাপের অঞ্চল এবং অস্ট্রেলিয়াইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত নিম্ন তাপমাত্রা ও উচ্চ-চাপ সৃষ্টি করে। ফলে আমেরিকার পেরুচিলি অঞ্চলে প্রচন্ড বৃষ্টিপাতবন্যাঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখা যায় যেখানে ঠিক একই সময়ে অস্ট্রেলিয়াইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে দাবদাহখরা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। 

এল নিনোর এই বিরুপ প্রভাবে অস্ট্রেলিয়াইন্দোনেশিয়া ও পার্শবর্তী অঞ্চলে ফসল নষ্ট হয়পানির অভাব সুদৃঢ় হয় এবং দাবানল বেড়ে যায় হু হু করে। বিপরীতভাবেআমেরিকায় তখন মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বন্যা দেখা যায়যা ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবিকানির্বাহে ব্যাঘাত ঘটায় এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি করেবাড়ায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। এর বাইরেওএল নিনো জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের অসামান্য ক্ষতি সাধন করেবিপন্ন করে জীববৈচিত্র্য। এটি প্রবাল প্রাচীর এবং বেঁচে থাকার জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল অগণিত প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। 

এল নিনোপ্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রের উপরিভাগের তাপমাত্রার তারত্যমের ফলে প্রতি ২-৭ বছরে সৃষ্ট একটি জটিল জলবায়ু সম্পর্কিত ঘটনাযা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার ধরণ পরিবর্তনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরেও বিস্তৃতবাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলীয় অন্যান্য দূরবর্তী দেশগুলির আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনকে এটি প্রভাবিত করে। দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিতবাংলাদেশ তার বিশেষ ভৌগলিক অবস্থান এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে এল নিনোর বিরূপ প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এল নিনোর কারণে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রীষ্মকালীন বর্ষা দুর্বল হয়যা বাংলাদেশের কৃষি ও পানি সম্পদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। ফলে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়এমনকি দেশের কিছু অংশে দেখা যায় খরা পরিস্থিতি। এল নিনো বছরগুলিতেবাংলাদেশ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা অনুভব করেযা এখানকার ফসলের উৎপাদনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।  

বাংলাদেশে এল নিনোর পরিবেশগত প্রভাব বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী। যার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণবাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক ধরণে পরিবর্তনদেশের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। পাশাপাশি কম বৃষ্টিপাত কৃষি কার্যক্রমকে ব্যাহত করেখাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকাকে প্রভাবিত করেবিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে কৃষিই ঐ অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদন্ড। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ক্লাইমাটোলজির এক গবেষণায় জানা যায়এল নিনো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় তাপপ্রবাহকে অধিকরতর তীব্র করার পাশাপাশি এখানকার মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি করেছে। এল নিনোর প্রভাবে সৃষ্ট ক্রমহ্রাসমান বৃষ্টিপাত এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সংমিশ্রণে বাংলাদেশে পূর্বের তুলনায় খরার ঝুঁকি বেড়েছেকৃষিসেচ এবং গার্হস্থ্য ব্যবহারের পাশাপাশি পান করার প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভরশীলতা বহুগুণ বেড়েছে।

বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করাতীব্র বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি বাড়ায় এল নিনো। ১৯৯৮ সালের বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে প্লাবিত করা বিধ্বংসী বন্যা এল নিনোর কারণে আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ছাড়াওএল নিনো বাংলাদেশের উপর গভীর আর্থ-সামাজিক প্রভাব ফেলেসমাজের মধ্যে বিদ্যমান দুর্বলতা এবং অসমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় এটি। কৃষি খাতযার উপর জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কর্মসংস্থান এবং ভরণ-পোষণ নির্ভর করেএল নিনো-প্ররোচিত আবহাওয়ার অসামঞ্জস্যতার কারণে এই খাতেও ধারাবাহিকভাবে উৎপাদনশীলতা কমছেখরা বা বন্যায় কৃষকদের আয় কমেছেদারিদ্র্য বেড়েছে এবং দানা বেঁধেছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার চক্র। অধিকন্তুবৃহত্তর অর্থনীতির ক্ষতিসাধন করার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়খাদ্যের দাম এবং বাজারের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে এল নিনো।

১৯৮৭ সালের বন্যা১৯৯৭ এর খরায় বাংলাদেশে এল নিনোর সক্রীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়। ২০১৫-১৬ সালের এল নিনোবাংলাদেশে ধানের উৎপাদন কমায়যা পরবর্তিতে সৃষ্টি হওয়া মুদ্রাস্ফীতি এবং খাদ্য ঘাটতির অন্যতম একটি কারণ। যার ফলে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভূমিহীন শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকসহ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করা জনগোষ্ঠী। এছাড়া বন্যা এবং ক্ষয়প্রবণ নিম্ন-উপকূলীয় অঞ্চলে এল নিনোর তীব্রতাপ্রভাব ও আকস্মিকতা মানুষের জীবন ও জীবিকা এবং বসতিগুলির জন্য বার্তি ঝুঁকি তৈরী করে। বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যাতীব্র আবহাওয়ায় পরিবেশগত অবনতি এবং জলবায়ু-প্ররোচিত অভিবাসনবিদ্যমান সম্পদ ও অবকাঠামোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেযা সামাজের মানুষের মধ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং একটু একটু করে নষ্ট করে সমাজের স্থিতিস্থাপকতা।

তবে ইদানিংকালে পর্যবেক্ষণমূলক তথ্যসংখ্যাসূচক মডেলিং এবং তাত্ত্বিক কাঠামোর সংমিশ্রণের মাধ্যমেএনসো গতিবিদ্যার জটিলতাগুলি উন্মোচনে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তাদের তৈরী জলবায়ু মডেলগুলি এখন নির্ভুলভাবে এল নিনোর সূত্রপাততীব্রতা এবং সময়কালের পূর্বাভাস দিতে পারেযা এল নিনোর বিপরীতে উপকোলীয় জনগোষ্ঠীর প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়ায় বিশেষ অবদান রাখে। এল নিনো বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জযার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশের পরিবেশ এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোগুলোতে ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। এল নিনো একটি পর্যাবৃত্ত প্রাকৃতিক ঘটনা যা নির্দিষ্ট সময় পর পর পুনরায় দৃশ্যমান হয়। তাই আমাদের জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে এল নিনো সংক্রান্ত জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এল নিনোর বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করতে সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা রক্ষায় জলবায়ুর পরিবর্তন সহনশীল অবকাঠামো নিমার্ণটেকসই কৃষি অনুশীলন এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় বার্তি বিনিয়োগ অপরিহার্য। অধিকন্তুজলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মুকাবিলায় নিম্ন অর্থনীতির দেশগুলির জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সংহতি প্রয়োজন।

 

মো. রাফছান,
শিক্ষার্থীমেরিন সায়েন্সচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল : rafsan.cu.ac@gmail.com

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন