ফিচার : আগামির বাংলাদেশ ও তারুণ্যের ভাবনা





ফিচার : আগামির বাংলাদেশ ও তারুণ্যের ভাবনা


শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়নের কালো অধ্যায় পেরিয়ে ছাত্রজনতার ১ দফা আন্দোলনের মুখে গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচারমুক্ত হয় আমাদের বাংলাদেশ। সুদীর্ঘ যুগ ধরে অবহেলিত এদেশের সর্বসাধারণ তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে নতুন করে গঠিত হয়েছে অন্তর্বতীকালিন সরকার। তাদের কাছে একটি শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জনগনের সম্পৃক্তার পাশাপাশি ছাত্রসমাজ তাদের তাঁদের মেধা, শ্রম এবং প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ণ চায়। তারা প্রত্যাশা করে, বিগত সরকারের আমলে সুযোগে ভোগ দখলের যে কালো রাজনীতি চলেছে, পরের টাকা মেরে খেয়ে উপরে উঠার যে এলোমেলো প্রতিযোগিতা দেশে শুরু হয়েছে, মিথ্যার আড়ালে লুটপাটের নামে যে মাথাচারা দিয়ে উঠার এই অপসংস্কৃতিগুলো অচিরেই শেষ হবে। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে একটা স্বাধীন, সার্বভৌম, স্বৈরাচারমুক্ত, সুষম, নিরাপদ বাংলাদেশ গঠিত হবে, এমনটাই তাদের চাওয়া। একটি বৈষম্যবিহীন, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্র সমাজের প্রত্যাশা তুলে ধরছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মো. রাফছান।


আগামীর বাংলাদেশ হোক সাম্যের প্রতিচ্ছবি


যুগে যুগে নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে সংগ্রামী জনতা স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকার পতনের মাধ্যমে আমাদের দেশেও ঘটেছে স্বাধীনতার পুনর্জাগরণ। জাতি হিসেবে অত্যাবশ্যকীয় ও অপরিহার্য সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করাই এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আমরা চাই, বাংলাদেশ হয়ে উঠুক একটি ন্যায়নিষ্ঠ, বৈষম্যহীন সাম্যের প্রতিচ্ছবি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যেখানে প্রতিষ্ঠা পাবে সকল মানুষের সমান অধিকার। প্রত্যেক সেক্টরে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈষম্য দূর হোক। চিরতরে দুর্নীতি বন্ধ করে মেধা, যোগ্যতা আর দক্ষতাই হয়ে উঠুক এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। দেশের চলমান সংঘাত, নৈরাজ্য, আর দাঙ্গা সামাল দিয়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা দূর করতে হবে। সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বন্ধ করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে একটি অসাম্প্রদায়িক, সম্প্রীতির বাংলাদেশ। সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, হিন্দু-মুসলিম জাতিভেদ ভুলে সকলে মিলে সর্বসাধারণের যৌক্তিক দাবিগুলো সফল করাই এখন ছাত্রজনতার একমাত্র চাওয়া।


জুবায়েদ মোস্তফা,  

শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জরুরি


দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। দেশের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বিচার বিভাগকে করতে হবে অবাধ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের সর্বত্রই এই রাজনৈতিক কুপ্রভাব লক্ষ্য করা গেছে, যা সংগত বিবেচনাতেই নাগরিক অধিকারকে বিঘ্নিত করে। তাই সবার আগে গণতন্ত্র সুসংহত করা জরুরি। নির্বাহী বিভাগ শাসনের নামে শোষণ নয়, বরং জনগণের সত্যিকারের সেবকের ভূমিকা পালন করবে। থানা, প্রশাসন, আদালত হবে জনগণের আস্থার জায়গা। পাশাপাশি, দৈহিক শক্তি, অর্থবৃত্ত ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাউকে যেন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি না করা হয়, এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ নজরদারি রাখতে হবে। একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সর্বসাধারণের সম্মিলিত প্রয়াসের পাশাপাশি বিচার বিভাগের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাক আমাদের বাংলাদেশ।


মোমেনা আক্তার,

শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


তারুণ্যের শক্তিই রুখবে বাংলাদেশের দুর্নীতি


সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার তারুণ্যের শক্তি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকা ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সদ্য স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে অন্যায়, নৈরাজ্য আর অপশাসনের বিরুদ্ধে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারুণ্যের একতা, ন্যায়নীতি ও দেশপ্রেম। দুর্নীতির দুষ্টচক্রে দীর্ঘদিন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোও দুর্নীতিতে জর্জরিত। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও দুর্নীতির ভয়াল থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারেনি বিগত সরকার। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া এই দুর্নীতির বিষবাষ্প রুখে দিতে তারুণ্যের বিকল্প নেই। কেননা তারুণ্যের বজ্রকণ্ঠ, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের চেতনা শক্তি, সাহস ও মনোবল বৃদ্ধি করে। সাম্প্রতিককালে ছাত্র জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন ও সতস্ফুর্ত উপস্থিতিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। তারুণ্যের এই অপ্রতিরোধ্য শক্তিই আগামীর বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে, ইনশাআল্লাহ।


এস আর শাহিন,

শিক্ষার্থী, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।


মুক্ত চর্চার হাওয়া মাখা আগামীর বাংলাদেশ


বর্তমান সংবিধান সাধারণ মানুষের দাবি ও অধিকার আদায়ে তেমন কার্যকর নয়। এই দেশে চাকরি জীবনের পুরোদস্তুর মিশনে দুর্নীতির প্রহসন, প্রতিনিয়তই তারুণ্যকে ঠেলে দেয় হতাশার পথে। কখনো কোটার ফাঁদ, কখনো তদবির আর মামা চাচার দৌরাত্ম্যে প্রায়শই মুখ থুবড়ে পড়ে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম। তাই চলমান হতাশার এই উর্ধ্বমুখী গ্রাফে দাঁড়িয়ে থাকা আমরা, চাকরি চাই মেধার ভিত্তিতে। যেখানে 'ব্রেইন ড্রেন' কমিয়ে নতুন সরকার ব্যবস্থায় মেধাবীদের জন্য থাকবে প্রয়োগিক ডিগ্রি, প্রয়োজনীয় বাস্তবমুখী জ্ঞান ও গবেষণার সুযোগ। অতিরঞ্জিত বিসিএসের লেজুড়বৃত্তি থেকে বের হয়ে একেকজন তরুণকে হতে হবে উদ্যোক্তা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার কিংবা ব্যবসায়ী। নতুন কারিকুলামে যুক্ত করা হোক 'বিজনেস স্কিল' এবং বাড়তি 'ভাষা শিক্ষা'। তাছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের সর্বস্তরে প্রতিভার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই এখন দেশবাসীর একমাত্র চাওয়া। হাল আমলের মুখস্থবিদ্যার প্রহসনের সিস্টেম বদলে দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর প্রত্যেকটি মানুষই হয়ে উঠুক একেকটা দক্ষতার ক্ষেপণাস্ত্র। আগামী দিনে দেশপ্রেমীদের সমঝোতায় দুর্নীতির হাঁটু ভেঙ্গে গড়ে উঠুক আপনার আমার আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ।


মিজবাহুল জান্নাত তারিন,

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


দেশে সুশাসন ও আইন-শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরি

  

গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। সরকারবিহীন এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশে একটা অরাজক, অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। দেশব্যাপী সহিংসতায় অনেক মানুষের মৃত্যু, মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটতরাজ ও ডাকাতির অসংখ্য খবর প্রকাশিত হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে। এ সময়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন, সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা ও তাদের জানমাল রক্ষায় নিরলস পরিশ্রম করেছে দেশের সর্বস্তরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ। বিগত সরকারের আমলে, সরকারি আমলা, আইন শৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনী, সরকারপন্থি ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষমতার অবৈধ ভোগদখল ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এক নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। আইনের শাসনের অভাবে তাদের মধ্যে দেখা গেছে অন্যায়, জোর-জুলুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে অন্যের সম্পদ আত্মসাতের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে, চলমান সহিংসতা মোকাবিলা ও পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অনতিবিলম্বে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রয়োগ অপরিহার্য। আর, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, স্বচ্ছতা, এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন প্রশাসনিক সংস্কার। এছাড়াও, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলে জনগণের আস্থা অর্জন করাই হবে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। 


ছাদেক হোছাইন,

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


ফিচার লেখক : মো. রাফছান,

শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন