দূর্নীতি ও দারিদ্রমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ চাই






পরিকল্পিত নগরায়ন আর যত্রতত্র শিল্পায়নের এই ভুলের যুগে প্রাণের দাম কমেছে, কমেছে কৃষকের ন্যায্য পাওনা। আনুপাতিক হারে বেড়েছে যান চলিত যাতায়াত খরচের হিসেব, বেড়েছে স্কুল কলেজে পড়াশোনার ফি, বেড়েছে সাধারনের শ্রমে গড়ে ওঠা আকাশচুম্বী আমিন ম্যানশনে রাত্রি যাপনের তাড়া। ইট কংক্রিটের উঁচু দালান, জীবনের আবহাওয়া বদলায়নি, পরিবর্তন করেনি আমাদের মানসিকতার ছাঁচ। বাড়িয়েছে মানুষে মানুষে ঘনত্ব, খুন-খারাপি, অপহরণের সংখ্যা বাড়িয়েছে, নিত্যনতুন প্রতারণার ফাঁদে আরও বাড়িয়েছে শর্বনাশের ভয়। রক্তঘামে অর্জিত প্রবাসী রেমিটেন্সে ভোগ বিলাসের জমজমাট আসর বসিয়েছে ঢাকার ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ সৃষ্টির ৫৩ বছরে পাপ্তির খাতায় এক এক করে যোগ হয়েছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ক্রমবর্ধমান জিডিপি প্রবিদ্ধি, তৈরী পোষাক, মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, শিল্প-কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রসার, বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এক সময়কার তলাবিহীন ঝুড়ি খ্যাত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ, পুরো বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল।

স্বাধনীতার ৫৩ বছরে স্বাস্থ্য খাতে কিছুটা উন্নতি আসলেও প্রশ্নবিদ্ধই রয়েগেছে আমাদের সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে উন্নত চিকিৎসার নামে প্রতিনিয়তই চলছে টাকা পয়সা লুটতরাজের রমরমা ব্যবসা। নিয়ম করে প্রতিবারই দেশে ঔষধের দাম বেড়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৭০ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে কেবল মাত্র ঔষধের পেছনে। চিকিৎসা খাতে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে, ঔষধের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণ, প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনীয় মৌলিক চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ করার পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করা গেলে অচিরেই এই সেক্টরে সাফল্য ধরা দেবে।

বারংবার আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়মিতই বেড়িয়ে যাচ্ছে দেশের প্রভাবশালী, ধনকুবের, দূর্নীতিবাজরা। দেশের মোট সম্পদের অর্ধেকই পুঞ্জীভূত আছে এমন শীর্ষ ১০ ধনকুবেরদের কব্জায়। আশাকরি, দেশের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বন্টণ নিশ্চিতকরণ, সিন্ডিকেট শনাক্তকরণ করার পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরে দূর্নীতি রুখে দিয়ে অচিরেই উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে দেশ, বাঙালিরা পাবে দূর্নীতিমুক্ত একটি সুস্থ ও সুন্দর নিরাপদ ভূখণ্ড।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট-২০২১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যু হার উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় প্রায় দিগুণ। প্রতি বছর হাজারও মানুষ এই অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনায় অকালেই হারাচ্ছে জীবনের উইকেট। প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যে ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য, ইন্টারনেটের গতি, নিরাপত্তা, জীবন মানের সহজাত উন্নয়নের মত অসংখ্য বৈশ্বিক সূচকে তলানিতে আছে বাংলাদেশ। কর্তৃপক্ষের বুদ্ধিদীপ্ত রাষ্ট্রনীতি আর বাস্তবমুখী পরিকল্পনায় অচিরেই এসমস্ত দুর্দশা লাঘব করতে হবে।

ডিসেম্বর ২০২০ এ প্রকাশিত জাতিসংঘের ইউএনডিপি'র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক জ্ঞান এবং উচ্চশিক্ষার সূচকে ১৩৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ১১২তম ও  ১২৯তম। শিক্ষাখাতে এই ব্যর্থতার নেপথ্যে রয়েছে দেশের বিসিএস নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা। সবধরনের চাকুরি ক্ষেত্রগুলোতে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করণ, শিক্ষার মান উন্নয়ন, বাস্তব ও কর্মমুখী শিক্ষার বিস্তার, উচ্চ শিক্ষায় গবেষণায় বরাদ্ধের পরিমাণ ও মানসম্মত গবেষণার সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমেই শিক্ষা খাতের এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। 

বিকৃত চিন্তাভাবনার একদল শিক্ষিত মানুষই দেশটাকে চেঁটেপুটে খাচ্ছে, বিপরীতে দেশের জন্য কন্ট্রিবিউট করছে ফাইভ, এইট, টেন পাশ করতে না পারা একদল ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী, বুদ্ধির মারপ্যাঁচে মুখ থুবড়ে পড়া একদল অদক্ষ শ্রমিক। ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের এই প্রযুক্তির যুগে টিকে থাকতে এখনই  সময় সুষ্ঠু, গভীর, সুপরিকল্পনার, সমান সুস্বাস্থ্যের, সুষম শিল্পায়নের। এতে করে মানুষে মানুষে ভোগান্তি, দুর্ভোগ কমবে, পরিশ্রমের নৈপথ্যে সাধারনের মিলবে প্রাপ্য মূল্যায়ণ। নিরসন হবে নিত্যদিনকার যানজট সমস্যা, কমবে ছিনতাই, রাহাজানি অহরণের খবরে ভরা পত্রিকার পৃষ্ঠাও। জ্যামিতিক হারে বাড়বে কর্মসংস্থান, অসহায়, পরিশ্রমী সমাজ পাবে জীবন মানের পর্যাপ্ত মূল্যায়ণ।

দিনশেষে, একটি ক্ষুদা ও দারিদ্রমুক্ত নিরাপদ এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। যেখানে দেশ কিংবা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হবে উন্নত প্রযুক্তি ও আমাদের দেশের বিচক্ষণ ছেলে-মেয়েদের বুদ্ধিদীপ্ত আবিষ্কার ও জ্ঞান-গবেষণা। যেখানে স্থিতিশীল সহনীয় পর্যায়ে থাকবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য, দারিদ্রসীমা নেমে আসবে শূন্যের কোটায়। গ্রামের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নিশ্চিত হবে জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তবমুখী শিক্ষা, প্রতিটি মানুষের ন্যায্য অধিকার। সবাই যেখানে ন্যায় বিচার পাবে, নির্দিষ্ট সময়ের মাঝেই যেখানে অপরাধিরা পাবে প্রাপ্য শাস্তি। এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে সামাজিক বৈষম্য বিলিন হয়ে নিশ্চিত হবে প্রতিটি মানুষের সম অধিকার।

মোঃ রাফছান

শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Email: rafsan.cu.ac@gmail.com

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন