আমাদের শিশুরা জন্ম নেয় এক সমুদ্র প্রত্যাশা নিয়ে। বর্তমানটাকে জানার আগেইে তারা জেনে যায় তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা। শত জল্পনাকল্পনার পর প্রত্যাশার রঙ্গিন চশমা ভেঙ্গে দিয়ে একদিন ঠিকই তারা ভূমিষ্ঠ হয়। একটা সময় নির্বুদ্ধিতার পাঠ চুকিয়েই শুরু হয় তাদের ব্যুৎপত্তির জীবন। থমকে যাওয়া সময়, হৃদয় ভাঙ্গার ক্ষণ, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসার শুরু সেখান থেকেই। একটু একটু করে তারা বুঝতে শিখে, দেখতে শিখে, জানতে শিখে পৃথিবী আর তার মানুষ গুলোকে। প্রকৃত অর্থে জীবনের শুরুটাও সেখান থেকেই।
তারপর শুরু হয় বিদ্যালয়ের পাঠ্য জীবন। নতুন করে পরিচয়ের গন্ডিতে লিপিবদ্ধ হয় আরও কতগুলো নাম। ততক্ষণে দুর্বল কাঁধে চেঁপে বসে চারু খঁচিত একগাদা ভারী বই। একপা দুই পা করে তারা এগিয়ে যায় জীবন নামের যাঁতাকলে। সগৌরবে এগিয়ে চলা দুটি হাতের সাথে যুক্ত হয় আরও কতগুলো হাত। স্বপ্ন পূরণের পথে সেটাই তাদের প্রথম যাত্রা। ততদিনে একটা স্বপ্ন, ইচ্ছে , চাওয়া স্থির হয়ে যায়। অন্তত নিজের না হলেও পরিবারের কারো। ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার হওয়ার সীমানা নির্ধারিত হয়ে যায় হিসেবের ঝুলিতে।
পাঁচ-ছয় বছরের ছোট্ট ছেলে কিংবা মেয়েটার সকালে বের হয়ে সন্ধ্যায় একগাদা বই আর ব্যথার শরীর নিয়ে বাসায় ফেরার দৃশ্যটা বড্ড বেশি করুণ, হৃদয়বিদারক। যে সময়টাতে তাদের পুতুল খেলার কথা, সেই সময়টাতে আমরা তাদের মগজ চাষে লেলিয়ে দিয়েছি। অথচ, তাদের তখন প্রজাপতি ধরার সময়। আসলে দিনশেষে পরিবেশ, পরিবার, প্রতিবেশীরা জীবন গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। যে বয়সে তারা প্রকৃতি, প্রতিবেশী, পরিবার সম্পর্কে জানবে, সেই বয়সে আমরা তাদেরকে দু-চারটি বইয়ের ভাঁজে আটকে দিচ্ছি। কে জানে, তাদের স্বপ্ন গুলো এভাবে চোখের আঁড়ালেই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেঙ্গে দিচ্ছি কিনা!
এই অতিরিক্ত প্রত্যাশা করাটা আমাদের বর্তমান সমাজের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা একবারও ভাবিনা, যে নড়বড়ে মানুষগুলোর উপর প্রত্যাশার এই অভিশাপ চাঁপিয়ে দিচ্ছি, তারা এই বোঝা বইতে পারবে কিনা! পরিবারের বড় থেকে ছোট সন্তানের কাছেও আমাদের প্রত্যাশার কোনো কমতি নেই। জীবনে লক্ষ্য থাকতে হয় ঠিকই। কিন্তু, যে লক্ষ্য আপনারা তাদের বেঁধে দিচ্ছেন সেটা তাদের জন্য যথোপযোগী কিনা, অনিচ্ছার আরোপিত স্বপ্নে সন্তানটা বখে গেলো কিনা সেটা কখনো ভেবে দেখেছেন? প্রত্যাশার এই ভারী শেকল আসলেই কি ভালো কিছু বয়ে আনছে? নাকি দিনশেষে তৈরী করছে একরাশ হতাশা, নাকি জন্ম দিচ্ছে অবজ্ঞা আর অবহেলার। বিজ্ঞানের ছাত্রটাও দিনশেষে ব্যাংকে যাচ্ছে। ইংরেজির ছাত্রটা হচ্ছে বিচক্ষণ ব্যবসায়ী। সমুদ্র নিয়ে পড়া ছেলেটা হয়ে যায় বিখ্যাত কলামিস্ট। আসলে, লক্ষটা স্থির করতে হয়না। জীবন নদের গতিপথই লক্ষ্যটা স্থির করে দেয়।
দিনশেষে একটা ভালো ফলাফল পেতে প্রত্যাশার লিস্টটা একটু ছোট করে দিন। প্রত্যাশার বিপরীতে বড় করেন ভালোবাসা এবং ভালো রাখার দায়িত্বটাও। প্রত্যাশার এই ভারী বোঝা, কোমলমতি ছেলে মেয়েদের উপর ভালোর চেয়ে খারাপ প্রভাবটাই বেশি ফেলে। তাই, ভালো কিছু পেতে তার খুব একটা ভাল বন্ধু হয়ে যান। পূরণ করুন তার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো। তাকে মুক্ত আকাশে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে দিন। দেখুন, সন্তানটা কোন কাজটা ভালো করে। পড়ালেখার পাশাপাশি তাকে সে বিষয়টা চর্চা করার সুযোগ দিন। দিনশেষে এই সার্টিফিকেট, ডিগ্রির আসলেই কোনো মূল্য নেই। কেবল যোগ্যতার বলেই সবাই টিকে থাকে, থাকবে। নিজের সন্তানকে উচ্চ ডিগ্রিধারী করানোর পূর্বে যোগ্যতম হিসেবে গড়ে তুলুন। কথা দিচ্ছি, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনোই আর ভাবতে হবে না।
মো. রাফছান আহমেদ
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন