বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি ও ভারতের ভূমিকা



ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার পানি বণ্টন সংকট একটি দীর্ঘমেয়াদী জটিল রাজনৈতিক সমস্যা। ১৯৭১ এর স্বাধীনতার পর থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন ধাপে বহুবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে, বৈঠক হয়েছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, মেঘনা, এবং পদ্মাসহ দুই দেশের সর্বমোট ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীতে ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ এবং ৩৩টি নদীতে বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশে প্রায়শই তৈরি হয় পানি সংকট, দেখা যায় বন্যা, খরার মত ভূ-রাজনৈকিত ঘটনা। ভূপ্রকৃতি, ভৌগলিক অবস্থান ও বিভিন্ন আর্থসামাজিক কারণে এই নদীগুলোর উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল এই দেশের কৃষি, মৎস্য, বন এবং প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য। ভারত শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ সীমিত করে আবার বর্ষাকালে ছেড়ে দেয় অতিরিক্ত পানি, ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও জনজীবনে নেমে আসে মানবিক বিপর্যয়। তিস্তার পানি না পেয়ে ২০১৭ সালে উত্তরবঙ্গে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়, প্রভাব পরে দেশের খাদ্য উৎপাদনে। ভারতের একাধিক বাঁধ থেকে গত কয়েকদিনে বাংলাদেশে পানি এসেছে, ত্রিপুরার ডাম্বুর বাঁধ আর স্থানীয় বৃষ্টির পানি বাড়িয়েছে গোমতীর পানির স্তর, এই অতিরিক্ত পানির চাপে কুমিল্লা ও আশেপাশের অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ বন্যা। পানি এসেছে ভারতের হাওড়া, ধলাই, মুহুরি এবং খোয়াই নদী থেকেও। হালদা ও গোমতির বাঁধ ভেঙ্গেছে, ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কাপ্তাই হাইড্রো ইলেক্ট্রিক ড্যাম।

সবমিলিয়ে, বন্যা কবলিত হয়েছে ফেনি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, বাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষিপুর, সিলেট, কক্সবাজার খাগড়াছড়ি, নোয়াখালীসহ দেশের মোট ১১টি জেলা। জমি, বাড়িঘর, গৃহপালিত পশু আর সহায়-সম্পদ হারিয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঐ সমস্ত এলাকার বাসিন্দারা। তলিয়ে গেছে লাখো মানুষের ফসলি জমি, বসত-বাড়ি আর মসজিদ-মন্দিরের মত অসংখ্য ধর্মীয় উপাসনালয়। কিছু অঞ্চলে বন্যাপরিস্তিতি নিয়ন্ত্রণে আসলেও, নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে আরও বেশ কিছু অঞ্চল। গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, এখন পর্যন্ত ৫২ লক্ষ ৯ হাজার ৭৯৮ জন মানুষ পানিবন্দি হয়েছে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ জন। মানুষ এবং গবাদি পশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, শিশু-খাদ্য, গোখাদ্য ও শুকনা খাবার সর্বরাহের পাশাপাশি ব্যাক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিতরণ করা হয়েছে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, চিড়া, মুড়ি, গুর, খেজুর, মোমবাতি, টর্চ, কাপড়, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট, স্যালাইন, প্রয়োজনীয় ঔষদ ও স্যানিটারি ন্যাপকিন। বানভাসিদের উদ্ধারে কাজ করেছে সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ারসার্ভিস, দেশের বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী দল ও স্থানীয় লোকজন। ২০০০ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির বিপরীতে বন্য পরিস্থিতিতি মোকাবেলা ও বন্যার্তদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই ১০০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন, গঠন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল।

১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যা পুনরায় নবায়ন করা হয় ১৯৯৬ সালে। চুক্তি অনুযায়ী, গঙ্গার পানি ভাগাভাগি করার ক্ষেত্রে ১০ দিনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। গঙ্গা ব্যতীত অন্যান্য নদীর জন্য কোনো স্থায়ী চুক্তি না থাকায় বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে পানির সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং রাজ্যগুলোর স্বার্থরক্ষার জন্য বহুবছর ধরে ঝুলে আছে আমাদের তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি, যার কুফল ভোগ করছে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে তারা নদীগুলোতে পানির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। তিস্তার গজলডোবা বাঁধ, গঙ্গার ফারাক্কা  এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীর উপর ভারতের বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উজানে বাঁধের কারণে বাংলাদেশে নদীগুলোর পানির স্তর কমেছে, ব্যাহত হয়েছে কৃষিকাজে পানির সরবরাহ, মাটির লবণাক্ততা বেড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে, কমছে কৃষি জমির উর্বরতা। পানি স্বল্পতায় শুকিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য জলাভূমি, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মাছের প্রজনন, উপকূলীয় পরিবেশ। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির পর থেকে পদ্মায় পানির স্তর কমেছে ৬৫ শতাংশ, যা বাংলাদেশের কৃষি খাতে সৃষ্টি করেছে বড় রকমের বিপর্যয়।

১৯৯৭ সালের "ইউনাটেড ন্যাশন্স কনভেনশন অন দ্যা ল অব দ্যা নন-ন্যাভিগেশনাল ইউজ্যাস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস" চুক্তি আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানি বণ্টনের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এই আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী, প্রতিটি দেশকে অন্য দেশের অধিকার ও স্বার্থকে সম্মান জানিয়ে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানি বণ্টন করার সময় ন্যায্যতা এবং যৌথ ব্যবস্থাপনার নীতি অনুসরণ করতে হয়। এছাড়াও, ১৯৯২ সালের "হ্যালসিংকি রুল্স" এবং "বার্লিন রুল্স অন ওয়াটার রিসোর্সেস" আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের নীতি প্রণয়ন করে। কিন্তু, ভারত প্রায়শই এই আইন ও নীতিগুলো অগ্রাহ্য করে, হরহামেশাই গ্রহণ করে একতরফা সিদ্ধান্ত। তাদের একমুখী পানি নিয়ন্ত্রণ এবং বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিবাদ তথা ন্যায্য দাবি বারবার উপেক্ষা করেছে আমাদের এই প্রতিবেশি রাষ্ট্র। দেশের জনগণ ভারতের এই অসম পানি ব্যবস্থাপনাকে দেখছে কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে, যা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এমন অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণ, দুই দেশের প্রতিবেশী সম্পর্ককে করে তুলেছে আরও জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ।

ভারতের পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রতিনিয়তই একটু একটু করে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলাদেশের কৃষি এবং মৎস্যশিল্প, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। একটি গবেষণা অনুযায়ী, তিস্তা নদীর পানি না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ফসলের ক্ষতি হয়। ভারতের অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে সৃষ্ট বন্যায় সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয় বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ , সংকটে পড়ে দেশের আঞ্চলিক এবং স্থানীয় অর্থনীতি। ভারত-বাংলাদেশ পানি সংকটের মূল কারণ, একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণে ভারতের প্রভাবশালী অবস্থান এবং উভয় দেশের মধ্যকার সামঞ্জস্যহীন দুর্বল কূটনৈতিক সম্পর্ক। ভারতের অসম পানি ব্যবস্থাপনাকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা, বিপজ্জনক, আতঙ্ক-জাগানিয়া। দুই দেশের মধ্যকার যথাযথ আলোচনা ও সমঝোতার অপ্রতুলতা এই সংকটের আরেকটি অন্যতম কারণ। দুই দেশের পানি সমস্যায় ভারতের এমন একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করে, বাড়ায় সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশেকে ভারতের সাথে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রতিটি নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।

চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জেলার বন্যার্তদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের খাদ্য ও পুনর্বাসনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানি সংক্রান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জোরালো দাবি উত্থাপন এখন কেবল সময়ের দাবি। এছাড়াও বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে নির্মাণ করতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণ জলাধার। পানি সংরক্ষণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, বন্যার পানি ধরে রাখা ও তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাস্তাবায়ন করতে হবে সময়োপযোগী পরিবেশবান্ধব মেঘা প্রকল্প। আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তির অনুযায়ী উভয় দেশের স্বার্থকে সমানভাবে বিবেচনায় রেখে ভারত সরকারকে পানি বণ্টন করতে হবে। পানি নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা বজায় রেখে বাংলাদেশের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করা এখন তাদের মানবিক দায়িত্ব, যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক, ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হতে হবে। আন্তর্জাতিক নীতি এবং আইন মেনে প্রতিবেশি দেশ ভারতকে নিশ্চিত করতে হবে পানির সুষম বণ্টন, সমান সুযোগ-সুবিধা। এই সংকটের সমাধান, খুব শিগ্রই দুই দেশে সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা বয়ে আনবে, এমনটাই প্রত্যাশা করছে এপার বাংলার ভোক্তভোগী লাখো-কোটি সাধারণ মানুষ।

 

মো. রাফছান,

শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল : rafsan.cu.ac@gmail.com

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন