দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে



একটা দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ঐ দেশের মানুষের জীবন প্রবাহের ধরনের উপর শতভাগ নির্ভরশীল। আর জনসাধারণের জীবনপ্রবাহ নির্ভরশীল তাদের ব্যবহৃত নিত্যপয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যের উপর। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজার মূল্যের উর্ধ্বগতি মানুষের মধ্যে অস্থিরতার পরিমাণ বাড়ায়, বাড়ায় অধিক অর্থ উপার্জনের তাড়না। আর সেই উপার্জনের পথ সংকীর্ণ হলে স্বভাবতই সে পা বাড়ায় অসামাজিক, অনিরাপদ পথে। সামাজিক নিয়মে সে আটকে পড়ে, ছোট হয় পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে। আমাদের সমাজে জীবনকে সহজ করতে গিয়ে ভুল পথ বেছে নেওয়া এই মানুষগুলাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সমাজ থেকে একটু একটু করে ভালো মানুষ কমে, সংখ্যায় বাড়ে জীবনের কাছে মার খেয়ে অসদোপায় অবলম্বন করে বড় হওয়া সাহেবী গোষ্ঠী। 

সংখ্যাগরিষ্ঠ অসুদোপায়ীদের দ্বারা শাসিত সমাজে তখন অনৈতিক, অনিরাপদ বিষয়গুলো নরমালাইজ হয়ে যায়, পাপাচার সহজ হয়, অধিকতর সুবিধা বাড়ে অন্যকে মেরে নিজে বড় হওয়ার ধান্দায়। আর এই সবকিছুর পেছনে বিশের মত ছড়িয়ে পড়ে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতির অপয়া কলঙ্ক। যে বিশে নীল হয় সমাজ, ভাঙে ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পর্ক, পদে পদে বিশৃঙ্খলা বাড়ে, যত্রতত্র হার মানে মহামহিম, পরাক্রম নিরুপায় মানবতা। 

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সমাজে চক্রাকারে নৈরাজ্য সৃষ্টা করে, কিছুক্ষেত্রে যেটা পারমানবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর, আত্মঘাতি, আতঙ্ক জাগানিয়া। পরিবারের বার্তি খরচ মেটাতে সহসাই আলুর দাম বাড়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছেলের অতিরিক্ত শিক্ষাব্যয়ের হিসেব মিলাতে অসুস্থ রুগীর গলায় ছুরি লাগায় বেপরোয়া ডাক্তার, সময়ে-অসময়ে বাড়ে মানুষ বাঁচানোর মূল্য। জীবনের আয়-ব্যয় সামলে টিকে থাকার যুদ্ধে রাস্তাঘাটে জীবন বাজি রেখে অতিরিক্ত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করে বাস-মালিক সমিতির লোকেরা। 

কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাপে বেতনের স্কেল বাড়ায় সরকার, দ্রব্যমূল্যের এই মানবসৃষ্ট মহামারীর এই ধ্বংসলগ্নে নিজের পরিবার সামাল দিতে বাধ্য হয়েই ভুল পথে পা বাড়ায় তরুণ সমাজ, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক পৃথিবীর ঋণ নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় গর্ভের সন্তান। একই ভুলের কাফফারা হিসেবে রাস্তাঘাটে কসমেটিক্সের দাম বাড়ে, এই নিয়মেই বাড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের দুর্নীতির মাত্রা, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আবিষ্কৃত হয় কালো টাকা সাদা করার অভিনব কায়দা, বিচিত্র কলাকৌশল। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই কঠিন সময়ে কন্যাকে বিয়ে দিতে শরীরের কিডনি বিক্রি করেন বাবা, বেঁচে থাকার প্রশ্নে একে একে নিঃস্ব হয় কোটি কোটি পরিবার, সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে লাখো-কোটি সাধারণ মানুষ। এভাবেই দিনের পর দিন মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ে এই সামাজিক বোমা। যে বোমায় মসজিদ খালি হয়, মন্দিরে আগুণ লাগে, নির্বিচারে মারা পরে সাধারণ মানুষ, একটু একটু করে ধ্বংস হয় মৌলিক মানবিকতা। 

তাহলে সমাধান? সমাধান, খুব সহজ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্যের মূল্য কমিয়ে দিন, বিপরীতে বাড়িয়ে দিন বিলাসী পণ্যের দাম। বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলো সহজলভ্য করুণ, আলু, ভাত আর রুটির মূল্য রাখুন সর্বসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। দুই মুঠো ভাত আর একটা রুটি পেলে মানুষ আর চুরি করবে না, রাস্তাঘাটে গলায় ছুরি ধরে মুক্তিপণ চাইবে না বাইষোর্ধ্ব তরুণ যুবক। হসপিটালে অসুস্হ রোগীর চিকিৎসার ব্যয় বাড়বে না আর, বাজারে বার্তি দামে পণ্য বিক্রির সুযোগ নিবেনা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। ঋণের দায় নিয়ে পৃথিবীতে জন্মাবে না আর একটি মানব শিশুও। 

কোটি টাকার বাড়িতে না ঘুমালে মানুষ মরে না, লাখ টাকার পোষাকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবী। এই নিয়মের ফলে, ব্যক্তিগত বিমান সংখ্যায় কমার বিপরীতে সাধারণের মিলবে পারষ্পারিক স্বনির্ভরতা। দামি পাজোরো তে দুই মাইল না চড়ে পাবলিক বাসের উপর নির্ভরতা বাড়বে, কমবে মানুষে-মানুষে অর্থ উপার্জনের অসুস্থ প্রতিযোগীতা। কেবলমাত্র ভাত-কাপড়ের নিশ্চিয়তা পেলেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রাচুর্যতা ভুলে এই মানুষের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে স্রষ্টার উদ্দেশ্য, লিখিত হবে জীবনের গান, ভালোবাসার কবিতা।

 

মো. রাফছান,

শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: rafsan.cu.ac@gmail.com

লেখক Md. Rafsan

মো. রাফছান একজন লেখক, কলামিস্ট, সংগঠক ও গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স-এর শিক্ষার্থী এবং তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি-র প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তরুণদের সঙ্গে কাজ করছেন। সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমতা ও মানবিকতা-ভিত্তিক সমাজ গড়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।

0 Comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন