দেশব্যাপীই চলছে কোচিংওলাদের রমরমা ব্যবসা। ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতি মানেই এই কোচিং, ঐ কোচিং, বাংলাদেশ টু ফার্মগেট। প্রতিবছর এইসএসসি পরিক্ষার পর পুরো দেশ থেকে কোচিংয়ের উদ্দেশ্য ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ভীড় জমায় লাখো-লাখো শিক্ষার্থী। এক কোচিংকে কেন্দ্র করে ঢাকা আসা, বাসা নেওয়া, বই ও শিট কেনা ইত্যাদি, এ যেন শুধু টাকা আর টাকার খেলা। অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা আর জিনিসপত্রের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল্য হওয়ায় ঐ একটা মাত্র ভর্তি সিজনে সব রকমের খরচ মিলিয়ে ১ জন ভর্তিচ্ছু পরিক্ষার্থীর ভর্তি পরিক্ষার পূর্বপ্রস্তুতির ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ থেকে ২ লক্ষ টাকা। মেসের খাবারে অসুন্তষ্টি, আবাসন সমস্যা, যাতায়াতের দুর্ভোগ আর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাহীনতার অনিশ্চয়তা তো থাকছেই।
ছেলে-মেয়ের এইচএসসি রেজাল্ট হাতে পাওয়ার পর জীবনে কোনো দিন ভর্তি পরিক্ষা সম্পর্কে এক বাক্য না বলা মানুষ, শিক্ষক, প্রতিবেশিরাই সবার আগে প্রশ্ন করে, “এই মিয়া তোমার ছেলে কোন কোচিংয়ে পড়ে। আমার মেয়েকে তো ঐ কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছি।” জবাব পাল্টা জবাবে কথার খেলা চলে পর্দার দুপাশেই। এ যেন কোচিং নয় অভিভাবকদের পারিবারিক পদমর্যাদা কিংবা আত্মসম্মান বাঁচানোর মহা গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। দুর্বল নামের কোনো অখ্যাত কোচিং কিংবা পাড়ার কোনো শিক্ষক দিয়ে পড়িয়ে আত্নসম্মান নষ্ট করার ভোয়া ভয় পায় হাজারও অভিভাবক। বর্তমান সময়ের এই কোচিং-কোচিং খেলায় নিজেদের জীবনের সর্বস্ব দিয়ে বাবা-মায়েরা সন্তানদের ভালো পড়াশোনার বিপরীতে কখনো আবার সুনিশ্চিন্ত করেন নিজেদের পারাবারিক, সামাজিক কিংবা লোক দেখানো আত্নসম্মান। এতেই চলে উদ্ভাস, ইউসিসি, প্রাইম, রেটিনা, মেডিকো নামের কোচিং সেন্টারগুলোর জয়-জয়কার।
মাঝেমাঝে পরিক্ষার্থী, বাবা-মা কিংবা গার্ডিয়ানদের অযৌক্তিক, অপরিকল্পিত ইচ্ছে আর লোকদেখানো অতি আত্নসম্মানবোধেই দিনশেষে বলির পাঠা হয় ঐ ছোট্ট, দুর্বল, নিরুপায় পরিক্ষার্থী। অভিভাবকদের কে বুঝাবে, উদ্ভাস, ইউসিসি তাদের সন্তানকে প্রত্যাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা আসন পাইয়ে দিবে না, আসন পাওয়ার ঐ যোগ্যতা, মনোবল সে তো তার সন্তানের মাঝেই আছে। একজন পরিক্ষার্থী চাইলেই যেকোনো যায়গায় যেতে পারে, যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে। কাঙ্খিত বিষয়ে কেবল তার একাগ্রচিত্ত মনোবল, সময়-অসময়ের হার না মানা মানসিকতা, আশেপাশের মানুষের কিছু সঠিক দিকনির্দেশনাই দিনশেষে সাফল্যের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অভিভাবকেরা তাই কোচিং-কোচিং নামের এই আত্নসম্মানবোধের খেলা বন্ধ করুন, নিজের সন্তানের সঠিক ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতির জন্য একটা ভালো যায়গা নিশ্চিত করুন। সেখানেই তাকে দিন, যেখান থেকে সে তার সর্বোচ্চটা দিতে পারবে, নিজের মত করে শিখতে পারবে, জানতে পারবে, আহরণ করতে পারবে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, অর্জন করতে পারবে কার্যকরী জীবনমুখী শিক্ষা।
এছাড়াও অভিভাবকদের অপরিকল্পিত ইচ্ছা, অতি আত্মসম্মানবোধ আর অযৌক্তিক জুরাজুরিতে ভুল ক্যারিয়ার পছন্দ করে কিংবা ভুল বিয়য়ে ভর্তি হয়ে জীবন নষ্ট হওয়ার গল্পও অহরহ দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজে। ছেলে-মেয়েদের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা নষ্ট করেও তাদের জন্য প্রত্যাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভালো অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেন নি হাজারও নিরিহ বাবা। অথচ, কোচিং ছেড়ে বাইরের কোনো শিক্ষককে দিয়ে নিজ সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতি, যেন স্বপ্নেও ভাবেন না আমাদের অভিভাবকগণ। কোচিংয়ের হাজার টাকার বিপরতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে শূণ্য থালা প্রাপ্তির কোনো প্রতিউত্তর না থাকলেও বাড়ির পাশের অখ্যাত শিক্ষকের মাসিক ঐ সামান্য ৩-৪ হাজারেই তাদের সহস্রাধিক যদি, কিস্তু থাকে।
অনেক ক্ষেত্রে কোচিং করেও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে অকালেই ঝরে পড়ে অনেক সম্ভবনাময় তারুণ। সার্বিক বিবেচনায় অভিভাবকদেরকে সন্তানদের জন্য অবশ্যই সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুপরামর্শ নিশ্চিত করতে হবে। কেননা তাদের সঠিক, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও ইতিবাচক মনমানসিকতাই সন্তানদের এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র। এছাড়াও পরিক্ষার্থীদের নিজেদেরকে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞয়ী হতে হবে, নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, সর্বপ্রকার বাধা উপেক্ষা করে ধৈর্যসহকারে সঠিক পথে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে হবে, তবেই দিনশেষে সফলতা ধরা দেবে। নিজেদের মধ্যকার এই এগিয়ে চলার আত্নবিশ্বাস, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই দিনশেষে একদিন তাদেরকে পৌঁছে দেবে সাফল্যের দুয়ারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাশ, ফেল, সুযোগ পাওয়া না পাওয়ার বিষয়গুলো ইউসিসি, উদ্ভাস, রেটিনায় লেখা থাকে না, লেখা থাকেনা বাড়ির পাশের ঐ অখ্যাত শিক্ষকের কপালেও। সঠিক সিদ্ধান্ত নিন, সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতির জন্য সঠিক কোচিং সেন্টার পছন্দে কৌশলী হোন, নিজের সন্তানদের জন্য নিশ্চিত করুণ ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতির সর্বোত্তম যায়গা। ইনশাল্লাহ্, দিনশেষে আপনাদের সঠিক সিদ্ধান্ত, আর আপনাদের সন্তানদের হার না মানা মনোবল আর একাগ্রতাই দৃশ্যপট পাল্টে দেবে। প্ররিশ্রম শেষে ক্লান্ত শরীরে তারা খুঁজে পাবে বেঁচে থাকার নতুন পরিচয়, মাথাগোঁজার একটি নতুন ঠিকানা, নিজের করে পাবে বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়।
মো. রাফছান
শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্সেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন