এক বৃদ্ধ, নাম জানি না, ঠিকানাও জানি না, বয়স ৮০ কিংবা ৯০ ছুই ছুই। বয়সের ভাড়ে রক্তমাংসের সরল দেহ তরল হতে চলেছে। মোট হাড়ের অনেক গুলোই ক্ষয়ে গেছে, যেটুকু আছে সেটুকুতে কেবল কোনো রকম দাঁড়ানো যায়, আষ্টেপিষ্টে হাটা যায় মিনিট খানেক।
চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আমি যখন বাসে ওঠি তখনই মুটামুটি দৌড়ে এসে বাস থামালেন এই বুড়ো। ছোট্ট গড়ন আর দুর্বল শরীরের বাম বুকটায় আগলে রাখা সদ্য বিবাহিতা মেয়েকে গন্তব্যে পৌছে দেওয়াই যেন মরবার আগে তার একমাত্র কাজ।
বৃদ্ধ বাস থামালেন, টিকিট কাটলেন, মেয়েকে নির্দিষ্ট সিটে বসিয়েও তিনি ক্ষান্ত হলেন না। বাইরে থেকে জানালার পাশ দিয়ে বিদায় দিচ্ছেন, ঘোলা চোখেই একান্তর দৃষ্টিতে খালি বাসে খুঁজছেন পরিচিত মুখ। নেই, একটাও পরিচিত মানুষ নেই।
মহিলার পাশের সিটে বসার বদৌলতে বৃদ্ধ আমার কাছে তার মেয়ের নিরাপদে গন্তব্যে পৌছানোর সত্য সৌপার্দ করলেন। আমি হাত নেড়ে বুড়োকে আশ্বাস দিলাম।
বাসটা মাত্রই ছাড়বে, বুড়ো কোনোরকম হাত মুখ বাঁকিয়ে বাক্যজাল বুনছেন চেনা রক্তের সুতোয়। চোখটা ঘোলাটে, ক্লান্ত অবসাদ দেহ শূণ্যে ভাসিয়ে বুড়ো অপলোক চেয়ে রইলেন যতদূর এই দুচোখ যায়, মাইলের পর মাইল, দেশের পর দেশ।
মানুষের ভালো থাকার জন্য এর থেকে বেশি কি চাই, এই মেয়ে কি আদও কখনোও এক্সিডেন্ট করতে পারে? যে বাবা তার মেয়েকে এত ভালোবাসে, যে বাবা নিজের মেয়ের ভালো থাকার শর্তে আপন স্বাস্থ্যের বলিদান দেয় প্রচণ্ড রৌদ্রাগুনে, পাহাড়সম কাজের ভাড়ে, ক্লান্ত মাথার লোনা ঘামে, কর্মব্যস্ত অবসাদ শরীরে, তাদের মেয়ে কেমন করে খারাপ থাকে?
এই মেয়েগুলো কখনোই খারাপ থাকতে পারে না, পারে? না, কখনোই পারে না। এই মেয়ে হয়তো ঠিকই নিশ্চিন্তে পৌছে যাবে তার আপন ঠিকানায় কিন্তু ক্লান্ত বুড়োর ঐ অন্তরদৃষ্টি, ঐ মহিমান্বিত ছোট্ট মেয়ের ভালো থাকার চাওয়া, ঘর্মাক্ত শরীরের লবনাক্ত ঘাম, শেষ বিদায়ের মমতাময় স্পর্শ লেগে থাকবে প্লাস্টিক বাসের কোনো কঠিন লোহায়, পিচঢালা রৌদ্রদগ্ধ প্রতিটা ধূলিকণায়, কিংবা লিখা থাকবে সময়ের খাতার কোনো অসমতলীয় অধ্যায়ে।
ভালো থাকুক প্রতিটা বাবার আদুরে মেয়েরা, জন্মজন্মান্তর ধরে বেঁচে থাকুক কল্যাণকামী দুর্বল দেহের বাবা নামের এই সার্বভৌমিক পতাকা।
মোঃ রাফছান,
শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন